কেবলই দাম বাড়ানোর চেষ্টা, মহাসংকটে সাধারণ মানুষ

0
179

ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বগতির দিকে। সরকারের ন্যায্যমূল্যের পণ্য বিক্রির টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের দীর্ঘলাইন প্রতিদিন বড় হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও সবাই ন্যায্যমূল্যের পণ্য পাচ্ছেন না। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যুৎ-গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। সাধারণ মানুষ বলছেন, জ্বালানির দাম বাড়লে আরেক দফা নিয়ন্ত্রণহীন হবে পণ্যের বাজার। স্বল্পআয়ের মানুষের বৃহৎ অংশের ওপর নেমে আসবে আরও কষ্ট। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন- এ অবস্থায় জ্বালানি মূল্য বাড়লে মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসবে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন ভর্তুকির চাপ কমাতে দাম বাড়াতেই হবে।

গ্রাহকপর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে এক বৈঠকে গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রকৃত গরিবরা যেন সরকারের ভর্তুকির সুবিধা পায়, সেই কৌশল বের করতে বলেছেন তিনি।

ইতোমধ্যে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আগামী ২১ মার্চ থেকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানি শুরু হবে। এর পর হবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে শুনানি। এর আগে গত নভেম্বরে বেড়েছিল জ্বালানি তেলের দাম। এমনিতেই নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষের কষ্ট বেড়েছে। সামনের দিনগুলোয়ও সাধারণ মানুষের জন্য কোনো সুখবর নেই। উল্টো জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে দ্রুতগতিতে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আবার বাড়তে পারে জ্বালানি তেলের দামও।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের পর থেকে প্রায় ধারাবাহিকভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ দিন দিন বাড়ছে। ঘাটতি মোকাবিলায় বিরাট অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হয়। ভর্তুকির চাপ কমাতে গ্রাহকপর্যায়ে দাম বাড়াতে হয়। গ্যাসের বিষয়ে বলা হয়, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের উৎপাদন না হওয়ায় বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে ভর্তুকি বাড়ছে। সমন্বয় করতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানোর বিষয়ে সচরাচর ‘দুর্নীতি ও ভুলনীতিকে দায়ী করে আসছেন জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা। সরকারের ভুল পরিকল্পনার সমালোচনাও করছে ক্যাব, সিপিডি, তেল-গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটিসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

কনজ্যুমার অ্যাসোশিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, গত এক দশকে বিদ্যুতের দাম প্রায় ১১ বার বেড়েছে। এর মধ্যে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ এবং খুচরা দাম প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। একই সময়ে গ্রাহকপর্যায়ে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। সেচ ও পরিবহনে বহুল ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ডিজেলের দাম বেড়ে ৪৪ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ক্যাবের এম শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের বিভিন্ন কোম্পানি এখন আর কোনো সেবা প্রতিষ্ঠান নয়। এরা জনগণের সঙ্গে ব্যবসা করছে। কারণে-অকারণে দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে। সব দায়ভার জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে।

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি হিসেবে মূলত ব্যবহৃত হয় গ্যাস, কয়লা, ফার্নেস তেল ও ডিজেল। এবার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে বলেছে- গ্যাস-সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তরল জ্বালানি ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি বিদ্যুৎ নেওয়া হচ্ছে। ফার্নেস তেল আমদানিতে এখন শুল্ক ও কর বাবদ খরচ বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। কয়লার দামও বেড়েছে বিশ^বাজারে। এ ছাড়া লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজির) দাম বাড়ায় ইতোমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা পড়েছে। এসব কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো না হলে চলতি অর্থবছরে ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে পিডিবিকে। তাই পাইকারি পর্যায়ে ৬৪ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

পিডিবির কাছ থেকেই দেশের ছয়টি বিতরণ কোম্পানি বিদ্যুৎ কেনে। পিডিবি দাম বাড়ালে স্বাভাবিক কারণেই বিতরণ কোম্পানিগুলোও বিদ্যুতের দাম বাড়ায়। ইতোমধ্যে গ্রাহক পর্যায়েও দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো।

এদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সাম্প্রতিক শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এখনই ডিজেলে লোকসান করছে বিপিসি। ফলে আরেক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে।

উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। চাহিদা গড়ে ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্থেক বিদ্যুৎও কাজে লাগছে না। পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, দেশে এখন গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪০০ কোটি ঘনফুটের বেশি। সরবরাহ হচ্ছে কমবেশি ৩০০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট আমদানি করা গ্যাস। গ্যাসের সংকট রয়েছে আরও ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি।

পেট্রোবাংলার এক পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, নিজস্ব গ্যাসের উৎস সন্ধানে জোর না দিয়ে আমদানিতে বেশি আগ্রহী হওয় ওঠায় দেশ এখন জ্বালানি নিরাপত্তায় হুমকিতে পড়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, আমদানির দিকে যারা ঝুঁকছেন, তারা হয়তো ভাবতে পারেনি বিশ^বাজারে জ্ব¦ালানির মূল্য এমন ওঠানামা করতে পারে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এখনো সময় আছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের অনুসন্ধান উৎপাদনে জোর দেওয়া এবং একই সঙ্গে সব ক্ষেত্রে অপচয়রোধ করে সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here