Home ফিচার ৩৫০ কোটি টাকার ‘কাল্পনিক’ দায় ১৬ চিকিৎসকের ঘাড়ে

৩৫০ কোটি টাকার ‘কাল্পনিক’ দায় ১৬ চিকিৎসকের ঘাড়ে

0

এক মাস থেকে ৮ মাস পর্যন্ত বকেয়া বেতন না দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। প্রাপ্য চাওয়ায় লাঞ্ছিত করা হয়েছে শারীরিক ও মানসিকভাবে। আশিয়ান মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এভাবে ১৬ চিকিৎসককে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। এরপর প্রতিষ্ঠানের ৩৫০ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের দায় চাপিয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

ভুক্তভোগী চিকিৎসকরা জানান, ২৭ থেকে ৩০ জানুয়ারি- চার দিনে ১৬ চিকিৎসককে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের কারও কারও ৩ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া রয়েছে। সেই বকেয়া না দিয়ে উল্টো তাদের ওপর চাপানো হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা ক্ষতির দায়।

১৬ চিকিৎসকের অভিযোগ, অশিয়ান কর্তৃপক্ষ তাদের নানাভাবে হয়রানি করছে। মুক্তি পেতে তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন। সহযোগিতা চেয়েছেন চিকিৎসক নেতাদেরও। এমনকি নিরাপত্তার স্বার্থে থানায় জিডি পর্যন্ত করেছেন। তারা জানান, বেতন না দিয়ে মাসের পর মাস ঘোরানো, চিকিৎসকদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন, কথায় কথায় গালমন্দ করা, মামলা দিয়ে হয়রানির হুমকি, অনাকাক্সিক্ষত অপমান-অপদস্থ, পদে পদে হেয় করা এবং চাকরি থেকে জোরপূর্বক অব্যাহতিসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে আশিয়ান মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারা ক্লিনিক্যাল বিষয়ে অধ্যাপনা করতেন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতেন। তারা কলেজের প্রিন্সিপালের অধীনে নন। তারা হাসপাতাল পরিচালকের অধীনে কাজ করতেন। তাই এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই এবং বলার নেই।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রিকগনিশন কমিটির চেয়ারম্যান ও স্বাচিপ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ আমাদের সময়কে বলেন, ‘অনেক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নীতিমালা মানছে না। সরকার এসব কলেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাচ্ছে। আশিয়ান মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে বিএমডিসির পক্ষ থেকে পরিদর্শনের চিঠি দেই। কিন্তু তারা অসহযোগিতা করেছে। আইনত তারা এটি করতে পারে না।’ অচিরেই সভা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

জানা গেছে, গত ১৭ জানুয়ারি আশিয়ান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল এনএ রফিকুল হোসেন (অব) এক অফিস আদেশ দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘আশিয়ান মেডিক্যাল কলেজের চেয়ারম্যানের নির্দেশক্রমে হাসপাতালে কর্মরত সব চিকিৎসককে জানানো যাচ্ছে যে, চলতি জানুয়ারি ২০২২ এবং পরবর্তী মাসগুলোতে হাসপাতালে কর্মরত সবার বেতন-ভাতা পরিশোধের ব্যবস্থা চিকিৎসকরাই করিবেন। এ ব্যাপারে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে কোনো ভর্তুকি দেবে না।’

অভিযোগ উঠেছে, এরপর ২৬ জানুয়ারি চেয়ারম্যান সব শিক্ষক ও চিকিৎসককে ডেকে গালাগালি করেন। সেই সঙ্গে চিকিৎসকদের চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বলেন। এ সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সবার বকেয়া পরিশোধ করবেন। কিন্তু ২৭ জানুয়ারি অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সব চিকিৎসককে ডেকে ‘ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি’ নিতে বাধ্য করেন।

অব্যাহতি দেওয়ার একদিন পরে ৩১ জানুয়ারি হাসপাতালের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল এসএ রফিকুল হোসেন (অব) ডা. সাবিনা পারভীনকে চিঠি পাঠান। চিঠিতে বলা হয়, ‘গত ১০ বছরে প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যার দায় একজন চিকিৎসক হিসেবে আপনার ওপরও বর্তায়। আপনি রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে নিজস্ব চেম্বারে নিয়ে আলাদা চিকিৎসা দিয়েছেন। আপনার চাকরির মেয়াদে রোগীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ায় ক্ষতির হিসাব আগামী সাত দিনের মধ্যে দেওয়ার জন্য বলা হলো। অন্যথায় অত্র প্রতিষ্ঠান আপনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।’

এ বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাবিনা পারভীন জানান, তিনি হাসপাতালে যোগ দেন ২০২১ সালের ৭ আগস্ট। অব্যাহতি নিয়েছেন ২০২২ সালের ২৯ জানুয়ারি। চাকরি করেছেন ৫ মাস ২২ দিন। কিন্তু তার মাথায়ও পড়েছে ১০ বছরে ৩৫০ কোটি টাকা ক্ষতির কাল্পনিক দায়। তিনি বলেন, ‘আমাকে তারা অব্যাহতি দিতে বলেনি। কিন্তু আমি অব্যাহতি দিয়েছি। কারণ ওখানে কাজের কোনো পরিবেশ নেই। যখন অন্য চিকিৎসকরা অব্যাহতি দিতে থাকলেন, আমার মনে হলো আমারও এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা নিরাপদ নয়।’ প্রায় ছয় মাসের কাছাকাছি চাকরি করলেও একদিনেরও বেতন পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের ব্যবহার এত নোংরা, যা বলার মতো নয়।’

অব্যাহতি নিতে যেসব চিকিৎসককে বাধ্য করা হয়েছে তারা হলেন- গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক ডা. জেসমিন জাহান, সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাবিনা পারভীন, রেজিস্ট্রার ডা. সারাবন তহুরা, সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. সাদিয়া খান, অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নাইমুর রহমান, অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. মাহাবুবুজ্জামান, ডা. দেবাসিস কুমার, ডা. সুমাইয়া শারমিন, রেজিস্ট্রার (মেডিসিন) ডা. ওয়াহিদ মুরাদ চৌধুরী, শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রেবেকা আক্তার, নাক-কান-গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফেরদৌস কাদের মিনু, সার্জারির অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জামাল আবু নাসের, গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এসএম হোসেল রানা, ডেনটিস্ট্রি বিভাগের ডা. শামীম আল মামুন এবং ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার ডা. প্রিন্স শেখ।

এদিকে এই চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করায় জিডি করেছেন। জিডিতে একজন চিকিৎসক উল্লেখ করেছেন, ‘বকেয়া বেতন পাওয়ার জন্য মালিকপক্ষের কাছে আবেদন করলে তারা বেতন দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিতে বলে। আমি স্বেচ্ছায় অব্যাহতি দেই। এরপর থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছে, যা আমার পেশাগত দিক বিবেচনায় অত্যন্ত ঝুঁকপূর্ণ, পাশাপাশি আমার জীবনও ঝুঁঁকিপূর্ণ মনে করে জিডি করেছি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে আশিয়ান মেডিক্যাল কলেজের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল এসএ রফিকুল হোসেনের (অব) মুঠোফোনে চারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অপর এক কর্মকর্তাকে ফোন করলে তিনি এ নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here