Saturday, July 27, 2024
Homeঅনন্যানারী দিবস পালন করে নারীর কী লাভ

নারী দিবস পালন করে নারীর কী লাভ

প্রতিবছর মহাসমারোহে নারী দিবসে আমরা নানা প্রোগ্রাম, সেমিনার করে থাকি। নারীর উন্নয়নের বিষয়ে বড় বড় কথা বলি। এত সুন্দর গুছিয়ে বক্তব্য দিই যে, সবার প্রশংসা আর হাততালিতে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ নারীর এতে আদৌ উপকার হয় কি? যদি উপকারই হতো- তা হলে কি আমরা শুনতে পেতাম পাশের বাসার নারীর ওপর মধ্যরাতে শারীরিক নির্যাতনের কথা, নারীকে যখন-তখন অকথ্য ভাষায় গালাগালি করার কথা, নারীর কাছ থেকে তার সন্তানকে আলাদা করে দেওয়ার কথা? এত গেল ঘরের কথা।

ঘরের বাইরে নারীর অবস্থা কী? বেশিরভাগ নারীই কর্মস্থলে হচ্ছেন যৌন হয়রানির শিকার। কিন্তু কার কাছে তিনি এসব কথা বলবেন? অফিসে বলবেন? তা হলে কী তার চাকরি থাকবে? বাসায় জানাবেন? তা হলে হয়তো চাকরি ছেড়ে দেওয়াই দেবে বেশিরভাগ ব্যক্তি সমাধান। নতুবা তার চরিত্রও নিয়েই টানাটানি পড়বে। নারী শুধু বাইরে চাকরি করতে যান না, পড়াশোনাও করতে যান। যেখানে পড়তে যান, সেখানে যদি তার শ্রদ্ধেয় স্যার বা সহপাঠীর দ্বারা এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়- তা হলে তো তার জলে পড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে প্রথমত, তার ক্যাম্পাসে যাওয়ার ইচ্ছা মরে যায়। সহপাঠীর টিকা-টিপ্পনি, হাসি-ঠাট্টা হয় তার নিত্যসঙ্গী। তার ভেতরে জন্ম নেয় নানা ভয়। শুধু তিনি নন, আমাদের চারপাশের নারীরা তথা আমরা সবাই কমবেশি আমাদের ওপর ঘটা নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করি। ঘটনাটি যেন কেউ জানতে না পারে, এ জন্য লুকোচাপা করি। আমরা আত্মহত্যার পথে পা বাড়াই। প্রশ্নœ হলো, কেন? একবিংশ শতাব্দীতে নারীর এত ভয় কিসের?

আমরা যদি মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলের দিকে তাকাই, তা হলে দেখব- মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি ভালো ফল করছে। কর্মক্ষেত্রে তারা সফল। কিন্তু তাদের ওপর ঘটে যাওয়া অনাকাক্ষিত ঘটনায় তারা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। এর কারণ হিসেবে বলব- আমাদের অর্থাৎ নারীদের পরিবার এমনভাবে বড় করছে যে, আমাদের মুখ ফুটে কথা বলার অধিকার নেই। পরিবার আমাদের শেখাচ্ছে- কেবল সহ্য করে যাও। আমাদের দেশের নারীরা ঝুঁকিও নিতে ততটা আগ্রহী নন। একবিংশ শতাব্দীর মেধাবী নারীদের দেখছি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় আইনের আশ্রয় না নিতে। বেশিরভাগ নারী থানা-পুলিশ করাকে ঝামেলা মনে করেন। তাদের চরিত্রের ওপর কালিমা পড়বে- এ আশঙ্কায় তারা লজ্জায় মুষড়ে পড়েন। তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ না করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগের বিষয়ে আপসে চলে যান। কিন্তু এসব আপস কী তাদের শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারে? যদি সেটিই হতো, তা হলে নারীর ওপর সহিংসতা যারা করছেন, তারা তো এতদিনে থেমেই যেত। উল্টো নারীদের নিশ্চুপ থাকার ফলে তারা আরও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে এসব অপকর্মগুলো করে যায়।

আমাদের দেশের নারীদের কিছু আইন, বিধি, গাইডলাইনস মুখস্থ থাকা উচিত বলেই আমি মনে করি। প্রথমত, যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ছেন বা কর্মস্থলে কাজ করছেন, তারা খেয়াল রাখুন- তাদের প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি আছে কিনা? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে অভিযোগ দেওয়ার জন্য কোনো ‘কমপ্লেন বক্স’ আছে কিনা? আপনি যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হন, তা হলে অবিলম্বে সেখানে আপনার অভিযোগ করুন। সঠিকভাবে দৃঢ়চিত্তে যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযোগ করুন। কখনই মাঝপথে অভিযোগ প্রত্যাহার কাম্য নয়। মনে রাখবেন, উচ্চ আদালত ২০০৯ সালে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে যে গাইডলাইনসটি দিয়েছেন, তা আইনের মতোই কার্যকর।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদের মর্মার্থ অনুযায়ী যতদিন পর্যন্ত এ বিষয়ে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন না হবে, ততদিন পর্যন্ত সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে এই নীতিমালা অনুসরণ ও পালন করা বাধ্যতামূলক।

প্রশ্ন আসতে পারে, তা হলে কী কী কাজ যৌন হয়রানি?

ক. অনাকাক্সিক্ষত যৌন আবেদনমূলক আচরণ। যেমন- শারীরিক স্পর্শ বা এ ধরনের পরোক্ষ প্রচেষ্টা।

খ. প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা।

গ. যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি।

ঘ. যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন।

ঙ. পর্নোগ্রাফি দেখানো।

চ. যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি।

ছ. অশালীন ভঙ্গি, অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা কিংবা অশালীন উদ্দেশ্য পূরণে কোনো ব্যক্তির অলক্ষ্যে তার নিকটবর্তী হওয়া অথবা অনুসরণ করা, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে কৌতুক বলা বা উপহাস করা।

ঝ. চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস, ফ্যাক্টরি, শ্রেণিকক্ষ, বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোনো কিছু লেখা।

ঝ. ব্লাকমেইল অথবা চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে স্থিন বা ভিডিওচিত্র ধারণ করা।

ঞ. যৌন হয়রানির কারণে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা।

ট. প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা।

ঠ. ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কিংবা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন অথবা স্থাপনের চেষ্টা করা।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে অভিযোগ কমিটিতে কেউ যদি অভিযোগ করেন, তা হলে অভিযোগ কমিটির মূল কাজই হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগটি নিষ্পন্ন করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ প্রদান করা। অভিযোগ কমিটি ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, এ ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত সজাগ থাকুন।

ঘরে যেসব নারী প্রতিনিয়ত শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তারা আর কতকাল মুখ বুঝে এই নির্যাতন সহ্য করবেন? এসব পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষার জন্য ৯৯৯ নম্বরে (মোবাইল অথবা ল্যান্ডফোন) কল করুন। আপনার এই দুঃসময়ে সাহায্যত্রাতা হিসেবে ৯৯৯ থেকে প্রতিনিধি আপনাকে রক্ষার্থে ঘরে পৌঁছে যাবে।

রাস্তা-ঘাটে বা গণপরিবহনে নারীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হন। এ ক্ষেত্রে সর্বক্ষণ মাথায় রাখুন ১০৯ নম্বরটি। মনে রাখবেন, এসব জায়গায় বিপদে পড়লে কারও সাহায্য আশা করার চেয়ে নিজেই নিজেকে সুরক্ষিত করার জন্য ১০৯ নম্বরে কল করুন। সম্ভব হলে গণপরিবহনে ওঠার আগে পরিবহনের নম্বরটি জেনে নিন।

আমাদের দেশে নারীকে সুরক্ষিত করার জন্য নারী নির্যাতন দমন আইন ও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন রয়েছে। আইনগুলো শুধু কাগজ-কলমে কালো অক্ষরে শুধু লেখা থাকবে? আমরা নারীরা নানা রকম ঝামেলার ভয়ে বিপদে পড়লে এই আইনগুলো কখনো কী প্রয়োগ করতে চাইব না? তবে কি নারীর একমাত্র কাজই হবে চোখের পানি ফেলা? তা কখনই আমরা করব না। একবিংশ শতাব্দীর নারীকে হতে হবে আধুুনিক, প্রতিবাদী ও সাহসী। এসব আইন বা গাইডলাইনস যদি সঠিকভাবে জানি এবং বিপদে এ আইনগুলো থেকে সাহায্য নিই, তা হলেই আমরা নিজেদের সুরক্ষিত করতে পারব। এতেই ৮ মার্চের নারী দিবসে যেসব সভা ও সেমিনার হয়, সেগুলো সার্থক হবে। নতুবা তা শুধু একদিনের নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হবে। আমাদের একবিংশ শতাব্দীর নারীদের কাজ হবে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স।

মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular