Saturday, July 27, 2024
Homeফিচারছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া

ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া

হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এর প্রকোপ রাজধানীতেই বেশি। গত ১৭ দিনেই কলেরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২০ হাজার ২৭১ রোগী। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ১৯২ জন শুধু মহাখালী কলেরা হাসপতালেই ভর্তি হচ্ছে। সেই হিসাবে প্রতিঘণ্টায় গড়ে ৫০ রোগী হাসপাতালে আসছে। এদের মধ্যে ২৩ শতাংশই কলেরায় আক্রান্ত, যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। বর্তমানে অনেক জেলাতেও বাড়ছে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে ওয়াসার পানির ওপর বেশিরভাগ মানুষ নির্ভরশীল। মাটির নিচ দিয়ে টানা সেই লাইন এবং পয়ঃনিষ্কাশন নিষ্কাশন লাইন কোথাও কোথাও এক হয়ে যেতে পারে। আর সেই দূষণের কারণেই ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়া আবহাওয়ার পরিবর্তন, অত্যধিক উষ্ণতা,

অপরিচ্ছন খোলা খাবার এবং দূষিত পানীয় পান করায় ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় অনেকেই অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করছেন। খেতে শুরু করেছেন রাস্তার খোলা অস্বাস্থ্যকর খাবার। এমনকি স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতিও আগ্রহ নেই জনসাধারণের। তাছাড়া হঠাৎ করে দেশের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া অনেক মানুষ রাস্তার পাশে বিক্রি করা অস্বাস্থ্যকর পানীয় পান করছেন, যা থেকে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ, গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম আলমগীর আমাদের সময়কে বলেন, ‘ঢাকার পাশাপাশি নরসিংদী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, কুড়িগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়া রোগী বাড়ছে। আগাম গরম ও দূষিত পানি পান এবং স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষার কারণে পানিবাহিত এই রোগ বাড়তে পারে।’ তাই সবাইকে পানি ফুটিয়ে অথবা বিশুদ্ধকরণ করে পান করতে অনুরোধ জানিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ। পাশপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতিও গুরুত্বারোপ করেছেন।

আইসিডিডিআরবি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মহাখালীর হাসপাতালে গত ১৬ মার্চ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিল ১ হাজার ৫৭ জন। এর পর যথাক্রমে ১৭ মার্চে ১ হাজার ১৪১ জন, ১৮ মার্চে ১ হাজার ১৭৪ জন, ১৯ মার্চে ১ হাজার ১৩৫ জন, ২০ মার্চ ১ হাজার ১৫৭ জন, ২১ মার্চে ১ হাজার ২১৬ জন, ২২ মার্চে ১ হাজার ২৭২ জন, ২৩ মার্চ ১ হাজার ২৩৩ জন, ২৪ মার্চ ১ হাজার ১৭৬ জন, ২৫ মার্চ ১ হাজার ১৩৮ জন, ২৬ মার্চ ১ হাজার ২৪৫ জন, ২৭ মার্চে ১ হাজার ২৩০ জন, ২৮ মার্চে ১ হাজার ৩৩৪ জন, ২৯ মার্চ ১ হাজার ৩১৭ জন, ৩০ মার্চ ১ হাজার ৩৩১ জন, ৩১ মার্চে ১ হাজার ২৮৫ জন এবং ১ এপ্রিল বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৮৩০ জন এই কলেরা হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়। ২০০৭ ও ২০১৮ সালের পর এবারই দৈনিক এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হন। অর্থাৎ গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর আগেই শুরু হয়েছে ডায়রিয়ার ভয়াবহ প্রকোপ।

এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। তবে এবার সময়ের কিছুটা আগেই রোগী আসতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে রোগের জীবাণুর ধরন পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে। তবে সেটি গবেষণা না করে বা নিশ্চিত না হয়ে বলা সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘এবারের রোগীদের মধ্যে সিভিয়ার ডায়রিয়ার এবং কলেরায় আক্রান্ত রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। কলেরায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিগত সময়ের তুলনায় অনেক বেশি, যা মোট আক্রান্তের ২৩ শতাংশ।’

আইসিসিডিডিআরবিতে আসা বেশিরভাগ রোগীর অভিযোগ, ওয়াসার সরবরাহ করা পানির কারণেই ডায়রিয়া এবং কলেরার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেও এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা বলছেন- ওয়াসার লাইনে যে পানি আসছে তা অনেকটা সবুজাভাব, বাদামি বা হলুদ রঙের দুর্গন্ধযুক্ত ও দূষিত। দীর্ঘক্ষণ ফুটালেও তা পানযোগ্য হচ্ছে না। গন্ধ থেকে যাচ্ছে। আবার অনেকেই অভিযোগ করছেন- লাইনের পানির সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে নানারকম ময়লাও।

রাজধানীর গ্রিন রোডে বসবাস করেন একটি বেসরকারি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ। কথার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের বয়স সাত বছর। গত সপ্তাহে সে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর পর বাসায় বেড়াতে আসা এক আত্মীয়ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। প্রথমদিকে ভেবেছিলাম হয়তো হঠাৎ গরমের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আশপাশের ফ্ল্যাটের প্রায় সব পরিবারেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী রয়েছে। সবাই ধারণা করছেন, ওয়াসার পানির কারণেই ডায়রিয়া জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাসিন্দা ওবায়দুল্লাহ রনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই ওয়াসার লাইনে অপরিষ্কার পানি আসছে। নানারকম ময়লাও পাওয়া যাচ্ছে। কোনোভাবেই এসব পানি পানযোগ্য নয়। ফুটিয়েও পানের উপযোগী করা যাচ্ছে না।’ ওয়াসার পানি ব্যবহারের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, ‘সাধারণত সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে মিলে গেলেই পানি এভাবে দূষিত হয়। পাইপে ফুটো থাকার কারণে অথবা পুরনো ও পরিত্যক্ত পাইপগুলো বদলে নতুন পাইপ স্থাপনের সময় এই সমস্যা হয়ে থাকতে পারে।’

আইসিসিডিডিআরবির তথ্য মতে, রাজধানীর যেসব এলাকায় ডায়রিয়া ও কলেরা ছড়িয়েছে তার মধ্যে দক্ষিণখান ও যাত্রাবাড়ী অন্যতম। এর মধ্যে ২০১৯ সালে যাত্রাবাড়ী এলাকার পানির নমুনা পরীক্ষা করে স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় কলিফর্ম ও হেটারোট্রফিক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত করেছিল। সেই পরিস্থিতির যে উত্তরণ হয়নি, তা আইসিসিডিডিআরবি হাসপাতালের দেওয়া তথ্যেই পরিষ্কার। দায়িত্বশীলরা বলছেন, যাত্রাবাড়ীর কাছের এলাকা মাতুয়াইল থেকে আসা ডায়রিয়া রোগী অনেক বেশি। সেখানকার বাসিন্দা জমির গাজী গেল মাসে ডায়রিয়া নিয়ে মহাখালীর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, ওয়াসার পানিই তার পেটের পীড়ার প্রধান কারণ। গোসল ও ধোয়ামোছার কাজে এ পানি ব্যবহার করা গেলেও খাওয়া যায় না। ফুটানোর পরও গন্ধ থেকে যায়।

তবে হাসপাতাল থেকে রোগীদের তথ্য নিয়ে পানি পরীক্ষার পর, তাতে ডায়রিয়ার জীবাণু মেলেনি বলে দাবি করছে ওয়াসা। এ বিষয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা নিয়ম মেনে প্রতিদিনই নিজস্ব পরীক্ষাগারে পানির মান পরীক্ষা করি। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এসব পরীক্ষায় পানিবাহিত কোনো জীবাণুর অস্তিত্ব মেলেনি। ওয়াসার পানির মান আগের মতোই রয়েছে।’

এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেওয়ায় এখনই বেশকিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় কিছু না থাকলেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে এই রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। এর মধ্যে পানি ফুটিয়ে পান করা অন্যতম। বস্তুত ঝুঁকিমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পান করার কোনো বিকল্প নেই। আর ডায়রিয়ার প্রাথমিক অবস্থায় স্যালাইন ও অন্যান্য তরল খাবার, যেমন- ডাবের পানি, চিড়া ভিজিয়ে তার পানি, ডালের পানি, ভাতের মাড়, চালের গুঁড়ার জাউ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। আরেকটি সতর্কতা হল- রাস্তার পাশের খোলা খাবার বা শরবত জাতীয় পানীয় পরিহার করতে হবে। আর যে কোনো খাবার খাওয়ার আগে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করাও ডায়রিয়া প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। ভাইরাসজনিত এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে বৃদ্ধ ও শিশুর সংখ্যাই যেহেতু বেশি, তাই শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের দুধসহ অন্যান্য খাবার যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়ানোই সমীচীন।

এ বিষয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশাল মেডিসিনের (নিপসম) পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ আমাদের সময়কে বলেন, ‘কলেরা এক ধরনের ডায়রিয়া হলেও এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিন বা তিনের অধিকবার পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলে। নানা ধরনের জীবাণু দিয়ে এটি হতে পারে। যেমন- ই.কোলাই, ভিব্রিও কলেরি (ব্যাক্টেরিয়া), রোটা (ভাইরাস) ইত্যাদি। তবে যে ডায়রিয়া ভিব্রিও কলেরি জীবাণু দিয়ে সংঘটিত হয় তাকে কলেরা বলে। এতে বারবার পানির মতো তরল পায়খানা, সঙ্গে বমি হয়।’ কলেরা প্রতিরোধে ওয়াশকে মূলমন্ত্র উল্লেখ করে অধ্যাপক বায়েজিদ বলেন, ‘পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা- এই তিনটি শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ওয়াশ। অর্থাৎ নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাপূর্ণ জীবণাচরণ কলেরাসহ অনেক পানিবাহিত রোগ থেকে আমাদের রেহাই দিতে পারে। এ ছাড়া কলেরার টিকা?ও রয়েছে। নিয়মিত টিকা গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রীষ্ম আসার আগেই পুরো দেশে ডায়রিয়া রোগী বেড়েছে বলে আমরা সংবাদ পাচ্ছি। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীতে রোগী বেড়েছে বেশি। ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০ রোগী কলেরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। অবশ্য বিশুদ্ধ পানি পান ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ডায়রিয়া মোকাবিলা সম্ভব। রোগের প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যেই কলেরা শনাক্তকরণ কিট, প্রয়োজনীয় খাবার স্যালাইন নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশের জেলা এবং উপজেলা পর্যায়সহ সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- এবার ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে পারে, সবাই যেন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে।’

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular