বছর ঘুরে দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ

0
79

বৈশ্বিক মহামারী করোনায় মানুষের আয় বাড়েনি। কিন্তু বাজারে প্রয়োজনীয় পণ্যের পেছনে নিয়মিত খরচ কেবল বেড়েই চলেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেল ও ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি, করোনায় উৎপাদন কমে যাওয়া এবং সর্বশেষ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বাজার সামাল দিতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও স্বস্তি মিলছে না। উপরন্তু রোজাকে কেন্দ্র করে বরাবরের মতো সব পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে আটা, চিনি, ছোলা, বেসন, বেগুন, মুরগি ও গরুর মাংসসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক পরিবার খাবারের তালিকা ছোট করে আনতে বাধ্য হচ্ছেন। আমিষের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। সামান্য ডাল-ভাত কিনতে হিমশিম দরিদ্ররা। পরিবারের জন্য ইফতার ও সেহরির প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিনতে এসে কপালে ঘাম ছুটে গেছে বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মুস্তাফিজুর রহমানের। রাজধানীর মালিবাগ বাজারে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, রোজার মাসে ইফতার-সেহ্রির আয়োজনে অনেক কিছুই প্রয়োজন হয়। কিন্তু সামান্য বেতনের টাকায় বাজারের খরচের হিসাব মেলাতে পারছি না। অনিচ্ছা সত্তে¡ও বাজারে এসে দরকারি অনেক পণ্য বাদ দিতে হচ্ছে। মুস্তাফিজুর আরও বলেন, ১০০ টাকার নিচে মসুর ডাল পাওয়া যাচ্ছে না। চিনির কেজি ৮০ টাকা। ছোলার কেজি চাচ্ছে ৭৫ টাকা। গরু-মুরগি যে দাম, তাতে মাংস খাওয়া ছেড়েই দিয়েছি বলতে গেলে। সবজির দামেও আগুন। শশার কেজি ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা, সামান্য এক পিস লেবুর দাম ১৫-২০ টাকা চাচ্ছে।

নির্মাণশ্রমিক মো. মিজান বলেন, ‘রোজা এলেই বাজারে আগুন লাগে। আমাদের মতো গরিবের পক্ষে রোজায় রং-বেরঙের খাবার কেনা সম্ভব নয়। সামান্য ডাল-ভাত কিনতেই পকেটের টাকা ফুরিয়ে যায়। মোটা চালের কেজি ৫০ টাকা চাচ্ছে। মোটা মসুরের ডালের কেজি ১০০ টাকা। খোলা তেল কিনতে গেলাম; কেজি ১৬৮ টাকা। মসলাপাতির খরচও অনেক বাড়ছে।’

গত এক বছরের বাজার দর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার রোজায় জিনিসপত্রের দাম অনেকটাই বাড়তি। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, প্রতিবছর পণ্যের দাম বাড়ে, কিন্তু এ বছর রোজায় অনেকগুলো পণ্যের দাম বাড়তি রয়েছে। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ছোলা, সবজি ও মাংসের মতো পণ্যের দাম নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। খোদ সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবও বলছে, এক বছরের ব্যবধানে চলতি এপ্রিলে নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে।

২০২১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি অর্থাৎ রোজার সময় ৬০ থেকে ৬৮ টাকার মধ্যে সরু চাল এবং ৪৬ থেকে ৪৮ টাকার মধ্যে মোটা চাল পাওয়া গেলেও এবার রোজায় তা বেড়ে যথাক্রমে ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা এবং ৪৮ থেকে ৫০ টাকা হয়েছে। আটার দামেও ৫ থেকে ৬ টাকার ব্যবধান। বর্তমানে খোলা আটার কেজি ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা। মোটা দানার মসুর ডাল গত রোজায় ৬৮ টাকাতেও কেনা গেছে, যা এ রোজায় ১০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে ছোট দানার মসুরের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। গত রোজায় ৬৮ টাকায় বিক্রি হওয়া খোলা চিনির কেজি এবার বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। প্রতি কেজি ছোলা কিনতে এবার খরচ করতে হচ্ছে ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা, গতবার যা ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা।

সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বেড়েছে। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের লিটার এখন ১৫২ টাকায় ঠেকেছে। গত রোজায় যা ১২০ টাকায় কেনা গেছে। প্রতি রোজায় দাম বাড়ার দৌড়ে শীর্ষে থাকা বেগুনের দাম এবার সেঞ্চুরি ছুঁয়েছে। গেল বছর রোজায় যা ৫০ টাকাতেও পাওয়া গেছে। ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ এক হালি লেবু কিনতেও পকেট থেকে ৮০ টাকা খরচ হচ্ছে। গত রোজায় যা ৪০ থেকে ৫০ টাকায় মিলেছে। অন্যদিকে গরুর মাংস এখন বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। গত রোজায় ৫৫০ টাকাতেও পাওয়া গেছে, এবার গরুর মাংসের কেজি সর্বোচ্চ ৬৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস ব্রয়লার মুরগির কেজি কিনতেও গুনতে হচ্ছে ১৬৫ টাকা, গত রোজায় যা ১৪৫ টাকা ছিল। একইভাবে ডিমের দামও বাড়তি রয়েছে। গত রোজায় সবজির বাজারে একটু স্বস্তি পাওয়া গেলেও এবার সেটাও মিলছে না।

গতবছর ও এ বছর রোজায় চাল, খোলা আটা, খোলা সয়াবিন, মসুর ডাল (মোটাদানা), ছোলা, খোলা চিনি, ব্রয়লার মুরুগি, গরুর মাংস, লম্বা বেগুন, শশা, লেবু- এ ১১ পণ্যের বাজারদর পর্যালচনা করে দেখা গেছে, চালের দাম ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ডাল ৪৭ শতাংশ, খোলা আটা ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, খোলা সয়াবিন ২৫ শতাংশ, ছোলা ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, খোলা চিনি ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ, গরুর মাংস ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ, লম্বা বেগুন ৬৬ দশমিক ৬৬ টাকা এবং শশা ও লেবুর দাম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ হিসাব অনুযায়ী এ এগারো পণ্যের পেছনে ভোক্তার খরচ গড়ে ৩১ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে বাজারে খরচ বাড়ায় বেশিরভাগ মানুষ ইফতার ও সেহরিসহ রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করতে বাধ্য হচ্ছেন।

বাজারের দ্রব্যমূল্যের এ উত্তাপ ছড়িয়েছে জাতীয় সংসদেও। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বাজার নিয়ন্ত্রণে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সংসদ সদস্যরা। বিরোধীদলীয় সদস্যরা ক্ষোভ করে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এর মাশুল দিচ্ছে জনগণ।

রোজায় নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানতে উচ্চপর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠন ও তদারকি অভিযান জোরদার করাসহ প্রয়োজনীয় ৪০ পণ্যের পাইকারি ও খুচরা দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বেশিরভাগ পণ্য এখনো অতিরিক্ত দামেই বিক্রি হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার আমাদের সময়কে বলেন, ‘রমজানে বেশি চাহিদা থাকে, এমন পণ্যের বাজারে আমরা নজর রাখছি। পাশাপাশি সম্প্রতি ভোরবেলা বাজারে পণ্যের ট্রাকগুলোতেও নজর রাখা হচ্ছে। এর পরও তেল, বেগুন, শশা, লেবু, তরমুজসহ অনেক পণ্যে কারসাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা খতিয়ে দেখছি। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব পণ্যের দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তার পরও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে আমরা মাঠে রয়েছি। কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী পাইকাররা যাতে ২০ শতাংশ এবং খুচরা বিক্রেতারা ৩০ শতাংশের বেশি মুনাফা (খরচ বাদ দিয়ে) করতে না পারেন, সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে।’

বাজার ব্যবস্থাপনার ফাঁক-ফোকর দিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা করে নিচ্ছে বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, পণ্যের চাহিদা, মজুদ ও সরবরাহের পরিসংখ্যানে নিবিড় মনিটরিং দরকার। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলে রোজায় যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে, সেগুলোর দাম রাতারাতি বাড়তে পারবে না। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও পণ্য পরিবহনসহ বিভিন্ন ধাপে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। কারণ পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার পেছনে এগুলোও অন্যতম কারণ।

সরকারের নানা উদ্যোগের পরও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ উঠে আসছে বারবার। চালের উৎপাদনে রেকর্ড হলেও দীর্ঘ সময় ধরে বড় চালকল মালিকরা চালের বাজার চড়া রেখেছে বলে জানান কারওয়ানবাজারের চালের আড়ত চাটখিল রাইস এজন্সির ব্যবসায়ী মো. বিলাল হোসেন। তিনি বলেন, বড় চালকলগুলো সর্বপ্রথম দাম বাড়ায়, তাদের অনুসরণ করে অন্যরা বাড়ায়।

মালিবাগ বাজারের গাজী স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মাসুদ রানা বলেন, কেবল যে খোলা পণ্য তা নয়, রোজার আগ মুহুর্তে বড় বড় কোম্পানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। রোজায় চাহিদা বেড়ে যায় এমন সব পণ্যের দাম রোজার এক সপ্তাহ আগেই বেড়েছে। আটা, ময়দা, চিনি, দুধ, শরবত, বেসন, সেমাইসহ অনেক পণ্যের দাম প্রথম রোজা থেকে আরও বাড়তে শুরু করেছে।

বেগুন, শশা, কাঁচামরিচ, পেঁপে, লেবু, ধনিয়াপাতা, পুদিনাসহ রোজায় যেসব তরিতরকারির চাহিদা বেড়ে যায় এমন পণ্যের দামও সুযোগে বাড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। জানতে চাইলে রাজধানীতে সবজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স রিয়াদ এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ী বলরাম চন্দ্র আমাদের সময়কে বলেন, রোজায় মহাসড়কে চাঁদাবাজি বেড়ে যায়, মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যাও বাড়ে। পাবনা, রাজশাহী থেকে ঢাকায় পণ্য আনতে ট্রাকপ্রতি এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। গত মাসে দিতে হতো দেড় হাজার টাকা। এ বাড়তি খরচ পাইকারিতে যোগ হলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অন্যদিকে হাত বদলেও অনেকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তি লাভ করছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here