Saturday, July 27, 2024
Homeবাংলাদেশভাড়াটে বাদী ও পুলিশের মামলার ফাঁদে ব্যবসায়ী

ভাড়াটে বাদী ও পুলিশের মামলার ফাঁদে ব্যবসায়ী

গাজীপুরের নরওয়ে প্রবাসী ব্যবসায়ী ড. নুরুল ইসলাম শেখকে সাজানো মামলা দিয়ে ফাঁসাতে ভাড়ায় খাটেন এক নারী ও স্থানীয় থানা পুলিশ। এ কাজে ব্যবহার করা হয় সাথী নামে এক নারীকে। তাকে দিয়ে পৃথক তিনটি মিথ্যা মামলা করানো হয়। তিন মামলায় সাথীর যে নাম-ঠিকানা দেওয়া হয়, তার অস্তিত্ব নেই। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলার পাশাপাশি মাত্র ৩ পিস ইয়াবার মামলায় তাকে ফাঁসিয়ে দেয় গাজীপুরের জয়দেবপুর থানা পুলিশ। তবে হঠাৎ সাথীর অস্বাভাবিক মৃত্যুও জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। আমাদের সময়ের অনুসন্ধান ও পুলিশের একটি সংস্থার তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক বিরোধ ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রশাসনকে ব্যবহার করে নরওয়ে প্রবাসী নুরুল ইসলামকে একের পর এক হয়রানিমূলক মামলায় জড়িয়েছে। নুরুল ইসলামের অভিযোগ, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাংলাদেশ এবং নরওয়ে তিনি বসবাস করেন। এলাকার মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে বাংলাদেশ-নরওয়ে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

তবে এলাকার কিছু মানুষ তার সামাজিক সেবামূলক কাজে বাধা দিয়ে আসছে। তিনি যতবার দেশে আসেন, ততবারই কোনো না কোনো ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনায় জড়ানো হয়। এভাবে সুবিধা করতে না পেরে জয়দেবপুর থানা পুলিশের মাধ্যমে তাকে ৩ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটের মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। জামিনে বের হওয়ার পর আবারও সাথী নামে এক নারীকে দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করে। একইভাবে পারভীন আক্তার নামে ওই একই নারী দিয়ে যৌতুকের মামলা দেওয়া হয়। পাশাপাশি রাবেয়া আক্তার নামে এক নারীকে দিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করে।

আমাদের সময় অনুসন্ধান করে দেখেছে, নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করা সাথী, পারভীন ও রাবেয়া একই নারী। একটি চক্র তাকে মামলা করার জন্য ভাড়া করে। চক্রটির সঙ্গে ওই নারীর নিয়মিত যোগাযোগ হতো। মামলার উদ্দেশ্যই ছিল নুরুল ইসলামকে হয়রানি এবং তাদের দাবি করা চাঁদা আদায় করা। মামলায় জয়দেবপুর থানা পুলিশ কোনো প্রকার তদন্ত না করেই নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। তাকে গ্রেপ্তারের আগে মামলার বাদীর নাম ঠিকানা যাচাই করেনি। ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেনি পুলিশ। সবকিছুই করা হয়েছে অসৎ উদ্দেশ্যে।

একটি মামরার বাদী জয়দেবপুর থানার এসআই আবদুল হালিম। তিনি বর্তমানে কালিয়াকৈর থানায় কর্মরত। একজন নরওয়ে প্রবাসীকে ইয়াবার মামলায় গ্রেপ্তারের ব্যাপারে বুধবার তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘রাজু আহমেদ নামে মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে নুরুল ইসলামের নাম বলায় তাকে মামলার আসামি করা হয়। পরে তদন্তের পর চার্জশিট থেকে নুরুল ইসলামের নাম বাদ দেওয়া হয়।’

দ্বন্দ্বের কারণ হিসেবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নুরুল ইসলাম ২০১৮-২০ অর্থবছরে গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সভাপতি ছিলেন। জাকির হোসেন ওরফে মুমিত নামে এক ব্যক্তি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ রাজেন্দ্রপুর গাজীপুরের পরিচালক পদে প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তিনি এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস না করায় এবং নাগরিক সনদপত্রে জন্মতারিখ নিয়ে কিছুটা ভ্রান্তি থাকায় তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। প্রার্থিতা বাতিল হলে নুরুল ইসলামের সঙ্গে জাকির হোসেনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। জাকিরের ঘনিষ্ঠ গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সাবেক জেনারেল ম্যানেজার হাসান শাহ নাওয়াজের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব শুরু হয় নুর ইসলামের। হাসান শাহ তার অধীন সহকারী হিসাবরক্ষক আবুল কালাম আজাদকে দিয়ে নুরুল ইসলাম শেখের বিরুদ্ধে জিডি ও আদালতে অভিযোগ করেন। সেই ধারাবাহিকতায় একের পর এক মামলা হতে থাকে নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ-নরওয়ে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের পক্ষ থেকে থানায় করা এক অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বাবুল হোসেন, জাকির হোসেন ও সেলিম হাসপাতালের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় তারা লাঠিসোঁটা দিয়ে হাসপাতালে থাকা আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। এ সময় ক্যাশে থাকা এক লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে যায়।

অভিযোগের ব্যাপারে জাকির হোসেন মুমিত আমাদের সময়কে বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নির্বাচন করতে যাওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর ছোড়া হচ্ছে। তিনি পুলিশ কিংবা কোনো নারীকে দিয়ে নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করাননি।

জানা গেছে, পুলিশের ইয়াবার মামলায় ছাড়া পেয়ে নুরুল ইসলাম জেল থেকে বের হওয়ার পর গাজীপুর আদালতে তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মোসা. সাথী নামে এক নারী মামলা করেন। একই নারী মাত্র এক মাস পর রাবেয়া আক্তার নামে শ্রীপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। দুটি মামলাতেই নাম ভিন্ন হলেও মোবাইল নম্বর ও একই ছবি ব্যবহার করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সংস্থা বলছে, নুরুল ইসলামকে ফাঁসাতে একই নারীকে দিয়ে একটি চক্র তিনটি মামলা করিয়েছে। চক্রের সঙ্গে জড়িত গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সাবেক জিএম হাসান শাহ নাওয়াজ, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নেতা নির্বাচনে দ্বন্দ্বে জড়ানো জাকির হোসেন ও আয়নাল হক। তাদের সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় একজন আইনজীবী।

জানা গেছে, সাথী গাজীপুর সদর থানার ‘ছালেহাকুঞ্জ’ এলাকায় ভাড়া থাকতেন। তিনি ডিজে শিল্পী হিসেবে পরিচিত। গত ৫ সেপ্টেম্বর বাসায় ঝুলন্ত অবস্থায় আসমা আক্তার সাথীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তার মৃত্যু ঘিরেও নানা রহস্য দানা বেঁধেছে। তিনি কি আত্মহত্যা করেছেন, নাকি তাকে হত্যার পর লাশ ঝোলানো হয়েছে, এ প্রশ্নটিও এখন সামনে চলে এসেছে। তাকে দিয়ে একের পর মিথ্যা মামলা করানোর রহস্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে ঘটনার পেছনের কুশীলবরা তাকে হত্যা করতে পারে বলে কোনো কোনো সূত্র মনে করছে।

স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় অসাধু ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার করে হয়রানির অভিযোগ তুলে সম্প্রতি নুরুল ইসলাম উচ্চ আদালতে রিট করেন। জীবন ও স্বাধীনতার সুরক্ষা চেয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা এবং আবেদনকারীকে বেআইনি হয়রানির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করা হয়। আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করার নির্দেশ দেন। পিবিআই তদন্ত করে জানতে পারে, সাথী ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর দিয়ে ১ মাস ২৭ দিনে আয়নাল হক নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ২৩৯ বার কথা বলেছেন। জাকির হোসেনের সঙ্গে সাথীর কথা হয়েছে ৬ বার। এদিকে আয়নাল হকের সঙ্গে গত এক বছরে জাকির হোসেনের মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে ১৪৩ বার। একই সময় জাকির হোসেন মুমিত গ্রামীণফোন নম্বর দিয়ে গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সাবেক জিএম হাসান শাহ নাওয়াজের সঙ্গে ৪৪২ বার কথা বলেছেন। এতে বোঝা যায় তারা একটি চক্র। চক্রটি নুরুল ইসলামকে ফাঁসানোর জন্য সাথীকে ব্যবহার করে বারবার মামলা করে।

মামলার বাদী সাথীর সঙ্গে যোগাযোগ ও চক্রে জড়িত থাকার ব্যাপারে জাকির হোসেন বলেন, সাথী কিছু তথ্য দিতে তার সঙ্গে কথা বলেছিল। সেটা একদিনই কথা হয়। তিনি সাথীর মামলার ব্যাপারে কিছু জানেন না।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সাবেক জেনারেল ম্যানেজার হাসান শাহের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ এনে গাজীপুরে মানববন্ধন হয়। মানববন্ধনে নুরুল ইসলাম শেখের ইন্ধন রয়েছে ধারণা করে হাসান শাহ ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।

পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ধর্ষণ মামলার পরই বাদী সাথীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সঠিকভাবে মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন, স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ, তথা দক্ষতা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে প্রাথমিক তদন্ত করলে বাদীর অস্তিত্ব শনাক্ত করা করা যেত। ফলে নুরুল ইসলাম শেখ গ্রেপ্তার ও জেল-হাজতবাসের মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে পারতেন।

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular