Friday, September 20, 2024
Homeঅর্থনীতিকৃত্রিম সঙ্কটের পাঁয়তারা

কৃত্রিম সঙ্কটের পাঁয়তারা

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি সমন্বয় ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির উসিলায় ভোজ্য তেলেরও দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন, যাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই বাজারে ভোজ্য তেলের সরবরাহে সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। তবে কারওয়ান বাজারের সব দোকানে আগের দামেই এখনও তেল বিক্রি হচ্ছে।

বিক্রেতারা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী মাল পাওয়া যাচ্ছে না আর কোম্পানিগুলো বলছে, আমাদের সরবরাহ ঠিক আছে। বুধবার কারওয়ান বাজারের এক তেল ব্যবসায়ী বলেন, পুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির তেল পাচ্ছি না। অন্য কোম্পানিগুলো মাল আসছে না। এখনও আগের দামেই তেল বিক্রি করলেও কিছু দিনের মধ্যেই দাম বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি। অনেককেই দেখা যাচ্ছে বেশি তেল এনে গুদামজাত করা হচ্ছে। নোয়াখালী স্টোরে দেখা যায়, দোকানের সামনে প্রায় ৩০ কার্টন সয়াবিন তেল। দোকানের কর্মচারী জানালেন অর্ডার ছিল একটু আগেই দিয়ে গেছে। তাই সাজানো হয়নি। আরেক দোকানদার বলেন, এখনও তেল আগের দামেই বিক্রি করছি। তবে শিগগিরই দাম বাড়তে পারে।

মিরপুর পীরেরবাগের আল আমিন স্টোরের ব্যবসায়ী মো. আল আমিন বলেন, তেলের দাম বাড়াতে কোম্পানিগুলো আগের মতোই মাল কম দিচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী পাচ্ছি না।

অন্যদিকে অনেক দোকানেই আগের দামের ২০০ ও ২০৫ টাকার তেল দেখা গেছে। দোকানিরা বলেন, আগের তেল এখনও রয়ে গেছে। তবে নতুন দামেই বিক্রি করছি।

অন্যদিকে তালতলা মার্কেটে ব্যাপারি এন্টারপ্রাইজে কর্মরত একজন বলেন, আমার দোকানে আজ ৫ লিটারের ৫০টির বেশি বোতল ছিল। কিন্তু ২-৩ জন করে এসে একেকবার ৫-৬টা ৫ লিটারের তেলের বোতল কিনে নিয়ে গেছে। কিছু বলতে গেলে বলেছে, আমার টাকা দিয়ে কিনছি, তোমার সমস্যা কী। এখন আমার দোকানে আর একটিও ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল নেই।

তেলের দাম বাড়ার পেছনে ক্রেতাকে দায়ী করে একই রকম অভিযোগ করেছেন বাবুল স্টোরের মালিক কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, আমার দোকানে যা তেল ছিল তা দিয়ে আগামী ১৫ দিন চালানো যেত। কিন্তু কিছু ক্রেতা এসে ৫ লিটারের ৩-৪টা করে বোতল নিয়ে গেছে। না দিতে চাইলে উল্টা খারাপ ব্যবহার করে। তাদের টাকা আছে তারা তেল কিনে নেবে- আমি কেন দেব না এভাবে আমাকে হুমকি দিয়ে তেল নিয়ে গেছে।

মিরপুর ১৪-এর জেনারেল স্টোরের দোকানদার মাহাদি হাসান বলেন, দুদিন আগে এক ব্যারেল খোলা সয়াবিন তেলের অর্ডার করে এখনও পাইনি। পাঁচ থেকে ছয় লিটারের মতো খোলা তেল আমার কাছে আছে। তবে বাজারে প্রতি ব্যারেল খোলা সয়াবিন তেলের দাম দুই হাজার টাকা বেড়ে গেছে। ৩০ হাজার টাকার ব্যারেল এখন ৩২ হাজার টাকায় কিনতে হয়। পাইকারি বাজারে খোলা পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল না পাওয়া গেলে খোলা পাম অয়েল, সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ করে দিতে হবে বলেও জানান তিনি।

আরেক মুদি দোকানদার খয়বার মিয়ার টানা ৪০ বছরের মুদি দোকানদারি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ঝুলিতে। সয়াবিন তেলের দাম কেমন জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘হেইয়া ত মুই পাইতাছিই না। হবাই আইলাম বাজার তোন। যার দারে জিগায় হেয় কয়, তেল সট কাল আইয়েন।’

অবশ্য রামপুরা বনশ্রী বাজারের বড় একটি মুদি দোকানের মালিক মো. মাসুদ কাজী বলেন, আমার অর্ডার অনুসারে তেল পেয়েছি। আমার গ্রাহকদের চাহিদা অনুসারে তেলও রয়েছে আমার কাছে। তবে পরবর্তী অর্ডারে কী হবে সেটা তো এখনই বলতে পারি না। যতটুকু জানি তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে কি না জানতে চাওয়া হয় তেল উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত এক চাকরিজীবীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু দাম বাড়ানোর প্রস্তাব হতে পারে এ কথা শোনার পর তেলের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সামনে তেলের মূল্য কিছু বাড়তে পারে। এ ছাড়াও যারা পাম অয়েল ও সয়াবিন মিশিয়ে ব্যবসা করে, তারা আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে সেটি করতে পারবে না। কেননা পাম অয়েল জমে যাওয়া শুরু করবে এ সময় থেকে। এ কারণে সেপ্টেম্বর থেকে সয়াবিনের চাহিদা বেড়ে যায় সবক্ষেত্রে। এই চাহিদা বেড়ে যাওয়া অব্যাহত থাকে প্রায় মার্চ মাস পর্যন্ত। এ সবকিছু মিলিয়ে সয়াবিনের বাজারে অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে। কিন্তু ক্রেতা যদি স্বাভাবিক নিয়মে প্রয়োজন অনুসারে তেল কেনে, তা হলে এ সমস্যা অতটা জটিল হবে না। আর মূল্য বাড়ানো সর্বদাই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।

তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তাসলিম বলেন, আপনারা কাস্টমসে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন আমরা কত দামে তেল কিনছি। আর যে হারে ডলারের দাম বেড়েছে তাতে তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় কী? তেলের সরবরাহ সঙ্কটের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনও তেলের সঙ্কটের কোনো অভিযোগ পাইনি। আমাদের সরবরাহ ঠিক আছে। আমরা চাহিদা অনুযায়ী তেল দিচ্ছি।

অন্যদিকে দাম বাড়ানোর আগে তেলের সঙ্কট সৃষ্টি করা হয় এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে। নিয়ম অনুযায়ী বিচার-বিশ্লেষণ করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আমরা চাই সরবরাহ যেন বিঘ্নিত না হয়। মূল্য পরিস্থিতি যাতে সন্তোষজনক থাকে। সরকার সেটা নিশ্চিত করবে।

তেলের সঙ্কট সৃষ্টির বিষয়ে তিনি বলেন, যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ম্যানুপুলেট করে বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি করে থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

তেলের বাজারে সঙ্কট সৃষ্টির বিষয়ে ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, এখনও তো দাম বাড়ানোর বিষয়টি প্রস্তাবের পর্যায়ে আছে। শিগগিরই হয়তো একটা সিদ্ধান্ত আসবে। তবে বাজারে তেমন সঙ্কট সৃষ্টির আভাস দেখলে ভোক্তা অধিদফতর অভিযান চালাবে।

অন্যদিকে গত ৭ আগস্ট ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় দাম সমন্বয়ের জন্য বোতলজাত ভোজ্য তেলের দাম প্রতিলিটারে ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সর্বশেষ গত ২১ জুলাই তেলের দাম কমিয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। ওই সময় প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৬, প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮৫ এবং ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৯১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সয়াবিন তেলের পাশাপাশি পাম তেলের দামও ৬ টাকা কমানো হয়। পাম তেলের নতুন দাম ১৫২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু প্রায় ২০ দিন পার হওয়ার পরও বাজারে এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। এখনও সয়াবিন তেল প্রতিলিটার ২০০ থেকে ২১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular