Friday, September 20, 2024
Homeফিচার১২০ টাকার করুণ জীবন: দুপুরের খাবার তাদের লবণ মরিচডলা চা পাতা

১২০ টাকার করুণ জীবন: দুপুরের খাবার তাদের লবণ মরিচডলা চা পাতা

একজন চা শ্রমিকের দিনের মজুরি ১২০ টাকা, যা দিয়ে দুই কেজি চালই জোটে না। এর সঙ্গে শাকসবজি বা অনেক সময় পেঁয়াজ-মরিচই ভরসা তিন বেলার আহারে। মাছ-মাংস খাওয়া তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। মাসে এক দিনও জোটে না তাদের ভাগ্যে। শ্রমিক বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে জোটে না ঠিকমতো চিকিৎসা। বাগানে যে ডিসপেনসারি থাকে সেখান থেকে সর্ব রোগের ওষুধ হিসেবে দেওয়া হয় প্যারাসিটামল। এক রুম বা দুই রুমের খুপরি ঘরে স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে নিয়েই থাকতে হয়। তাও অনেক সময় থাকে না ঘরের চালে টিন, বৃষ্টি হলে ঘরে বসেই কাকভেজা হতে হয় সবাইকে। সন্তানের লেখাপড়া করানো সেটিও অনেকটাই দুঃস্বপ্নের মতো। সেই সঙ্গে আছে চা বাগানের কর্মকর্তাদের সেই ব্রিটিশ আমলকার প্রভুত্বের মনোভাব। এভাবেই খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন কাটছে চা শ্রমিকদের।

এই উচ্চমূল্যের বাজারে মাত্র ১২০ টাকার মজুরিতে টিকতে না পেরে চা শ্রমিকরা তাই আন্দোলনে নেমেছেন। এক সপ্তাহ ধরে তারা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছেন। তাদের দাবি দিনের মজুরি ৩০০ টাকা দিতে হবে। তবে মালিকরা বাড়াতে চান মাত্র ২০ টাকা। অর্থাৎ ১২০ টাকার মজুরি মালিকরা করতে চান ১৪০ টাকা, যা মানতে নারাজ শ্রমিকরা।

চা শ্রমিকরা এই অল্প মজুরিতে কীভাবে কষ্ট করে বেঁচে আছেন তার চিত্র ফুটে ওঠে শ্রমিকদের কথায়। মৌলভীবাজারের চা শ্রমিক চন্দন কুর্মী বলেন, আমার ছয় জনের সংসার চলে ১২০ টাকার মজুরি দিয়ে। আগে প্রতিদিনের মজুরি ছিল ১৮ টাকা, পরে হয় ২৫ টাকা। পরে আন্দোলন করে করে কয়েক ধাপে বেড়ে ২০১৯ সালে হয় ৮৫ টাকা। ২০২০ সালে বেড়ে হয় ১২০ টাকা। এই ১২০ টাকায় অনেক কষ্ট করে আমাদের চলতে হয়। আমাদের নিজেদের কিছু জমিন ছিল, কিন্তু রাবার বাগান করায় সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এ জন্য চা বাগানে কাজ করেই সংসার চালাতে হয়। সপ্তাহে সাত দিনই কাজ করতে হয়, কাজ না করলে টাকা কম দেয়। মজুরির বাইরে আর বাড়তি কোনো টাকা আমরা পাই না, বরং কোনো দিন যদি ২০ কেজির কম চা তুলি তা হলে তখনও মজুরি থেকে কেটে নেয়। এক কেজি কম হলে ৬ টাকা কেটে নেয়। অথচ আমরা যদি ২০ কেজির বেশি চা তুলি তখন কেজিতে দেওয়া হয় আড়াই টাকা।

আমার ৬ জনের সংসারে দিনে ২ কেজি চাল লাগে। এতেই চলে যায় ১০০ থেকে ১১০ টাকা। এর বাইরে তরিতরকারিসহ অন্যান্য জিনিস কিনতে আরও প্রায় ২০০ টাকা ব্যয় হয়। সব মিলিয়ে দিনে আমাদের ৩০০ টাকার ওপরে খরচ হয়। দিনের আয় ১২০ টাকায় যখন না পোষায় তখন আমাদের এক বেলা ভাত কম খেয়ে থাকতে হয়। যে বেলায় ভাত না খেয়ে থাকি সে বেলায় হয়তো কোনো দিন রুটি খাই, কোনোদিন কড়ই ভাজা খেয়ে থাকি।

আমরা এখন মজুরি ৩০০ টাকা দাবি করছি। সেই সঙ্গে ২০ কেজির বাড়তি চা পাতা ওঠালে সেগুলোর মজুরি কেজিতে ৬ টাকা করে দেবার দাবি জানাচ্ছি। কারণ এই টাকায় আমাদের পেটের ভাতই জোটে না। টাকার অভাবে আমরা সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারি ন। অনেক কষ্টে প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে, এরপর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তাদেরও চা বাগানের কাজে লাগিয়ে দিই।

তিনি বলেন, অসুস্থ হলে আমরা ঠিকমতো চিকিসাও করাতে পারি না। পেটে ব্যথা হলে প্যারাসিটামল দেয়, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হলেও প্যারাসিটামল, মাথাব্যথা হলেও প্যারাসিটামল এবং শরীরের কোথাও ঘা হলেও ওই প্যারাসিটামলই দেওয়া হয়। এই প্যারাসিটামল দেওয়া হয় বাগানে একটি ডিসপেনসারি রয়েছে সেখান থেকে। যদি একশ রকমের অসুখ হয়, তবু ওই প্যারাসিটামলই দেয়। যদি কোনো শ্রমিক গুরুতর কোনো রোগে আক্রান্ত হয়, তখন সরকারি হাসপাতালে পাঠায় এবং চিকিৎসার খরচ সব আমাদের নিজেদের দিতে হয়।

চা বাগানের যেসব অফিসার কাজ করেন তাদের আচার-আচরণ এখনও সেই ব্রিটিশ আমলের মতোই রয়ে গেছে। তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই। আমাদের ঘরের টিন নষ্ট হলে অফিসারকে বললে আমলে নেয় না। দেখা গেছে নষ্ট হয়েছে অনেক টিন, দিচ্ছে একটা টিন। ফলে বৃষ্টি হলে ঘরে বসেই ভিজতে হয় আমাদের।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার চা বাগানের শ্রমিক দয়াল আমলিকের বৃদ্ধ মা, বোন, স্ত্রী-সন্তানসহ মোট ৭ জনের সংসার। চা বাগানে কাজ করেন তিনি ও তার বৃদ্ধ মা। এই দুজনের আয়েই চলে তাদের সংসার।

এই চড়া উচ্চমূল্যের বাজারে কীভাবে চলে সংসার- এ প্রশ্ন করতেই দয়াল আলমিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, যেভাবে বেঁচে আছি এখন, তাকে বেঁচে থাকা বলে না। আমি প্রতিদিন যে মজুরি পাই আড়াই কেজি চাল কিনতেই শেষ হয়ে যায়। মায়ের মজুরির টাকা দিয়ে শাকসবজি, তেল-ডাল কিনতেই শেষ। এই টাকায় তিন বেলার খাবার জোটে না, তাই এক বেলা না খেয়ে কাটাতে হয় আমাদের। দুপুরে বেশিরভাগ সময় বাগানেই লবণ-মরিচ দিয়ে চা পাতা ডলে খেয়ে কাটাই।

তিনি জানান, চা বাগানে মূলত তিন রকমের শ্রমিক রয়েছে। এ ক্যাটাগরির শ্রমিক মজুরি পান দিনে ১২০ টাকা, বি ক্যাটাগরির শ্রমিক পান ১১৮ টাকা এবং সি ক্যাটাগরির শ্রমিক পান ১১৬ টাকা। চা বাগানে শ্রমিকরা তিন ধরনের কাজ করেন। চা পাতা তোলা শ্রমিক ছাড়াও চা বাগানে কাজ করেন জঙ্গল পরিষ্কার করা শ্রমিক এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা শ্রমিক। এই তিন প্রকারের শ্রমিককেই খেয়ে-না-খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়।

দয়াল আমলিক বলেন, আমি বি ক্যাটাগরির শ্রমিক, দিনে মজুরি পাই ১১৮ টাকা। সপ্তাহে আসে ৮২৬ টাকা। আমার পরিবারে দিনে চাল লাগে আড়াই কেজি, সপ্তাহে লাগে ১৫ কেজি। এখন ৫৫ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। এই দামে চাল কিনতে দরকার হয় ৮২৫ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহ শেষে চাল কেনার পর আমার হতে থাকে মাত্র ১ টাকা। এক টাকার তো আর এখন কোনো মূল্য নেই। তার মানে চাল কিনতেই আমার বেতনের টাকা শেষ। মায়ের আয়ের টাকা দিয়ে কোনো রকম শাকসবজি দিয়ে খেয়ে বেঁচে আছি। মাছ-মাংস তো মাসেও এক দিন খেতে পারি না আমরা। মাছ-মাংস খাওয়া আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। সন্তানরা অনেক সময় আবদার করে মাছ-মাংস খাওয়ার জন্য, কিন্তু কিনতে পারি না। তখন খুব কষ্ট হয় আমার। কারণ বাবা হিসেবে খুব অসহায় মনে হয়, মনে হয় আমি কেমন বাবা সন্তানের সামান্য চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারি না।

শুধু খাওয়া নয়, থাকার কষ্ট, সন্তানকে লেখাপড়া না করাতে পারার কষ্ট, ভালো কাপড়-চোপড় কিনতে না পারার কষ্ট। তা ছাড়া পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা না করাতে পারার কষ্ট। আসলে আমাদের জীবনটাই হলো কষ্টের। মাঝেমধ্যে মনে হয় চা শ্রমিক হওয়াটাই আমাদের জীবনের অভিশাপ।

চা শ্রমিক সঞ্জা ঘাটুয়াল বলেন, এখন সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। আগেও চা শ্রমিকদের দিনে একবেলা ভরপেটে খাওয়াও কঠিন ছিল। ১২০ টাকা দিয়ে আপনি কতটুকু চাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ ও ডাল কিনতে পারবেন? পুষ্টিকর বা সুষম খাবার তো অনেক দূর। চা শ্রমিকরা দিনের পর দিন এক বেলা খেয়ে আর উপোস থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যারা রেশনে চাল বা আটা পান, তারা এক বেলা খেতে পারেন। অনেকে সকালে একমুঠো চাল ভাজি করে রঙ চায়ের সঙ্গে খেয়ে কাজে যাই।

বলতে বলতে এই চা শ্রমিক বলে উঠলেন, রাতে কোনোমতে মাড়ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে যাই। কিন্তু কাজে গেলে শুধু ভুখ লেগে যায়। পিঠের ঝুড়ি তখন পেটে ঠেকে।

চা শ্রমিক বিশেষজ্ঞ ও চা শ্রমিক সন্তান প্রফেসর চিত্ররঞ্জন রাজবংশী বলেন, অস্থায়ী থেকে চা বাগানে স্থায়ী শ্রমিক হওয়াও আরেক যুদ্ধ। শ্রম আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে স্থায়ী করার নিয়ম রয়েছে। তবে ৬ থেকে ৭ বছর কাজ করেও স্থায়ী হতে পারেননি, এমন অসংখ্য শ্রমিক রয়েছে বলে চা শ্রমিকরা জানিয়েছেন। তারা বলেন, স্থায়ী শ্রমিকের পিএফ (প্রভিডেন্ড ফান্ড) কাটা হয়। অবসরের পর তিনি কিছু টাকা পান, যা শেষজীবনে কাজে আসে। যত দেরিতে স্থায়ী শ্রমিক করা হবে, তাতে কম টাকা দিতে হবে বলে স্থায়ীকরণে টালবাহানা করা হয়।

বাংলাদেশীয় চা সংসদ সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান জিএম শিবলী বলেন, আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। আমরা তো আলোচনা বন্ধ করছি না। তারা চাইলে আমরা মিটিং ডাকা। দাবি-দাওয়ায় ১০০টা পয়েন্ট থাকে। এই জন্য আলোচনায় সময় লাগে। সরকারের পক্ষ থেকে ডিজি (শ্রম অধিদফতরের) চিঠি দিয়েছেন। পাতা না তুললে দুপক্ষেরই ক্ষতি। এ মৌসুমে একজন শ্রমিক ৫০ কেজি থেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত পাতা তুলতে পারে। সপ্তাহে দুই-তিন হাজার টাকা বেশি রুজি করতে পারে।

ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যান জানান, একজন চা শ্রমিকের পেছনে মজুরি, রেশন, বাসা, মেডিকেল, বোনাসসহ মালিকের মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, কদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সারা দেশের চা শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করছেন। তিনি বলেন, শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের মধ্যে সবচেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন দেশের চা বাগানের শ্রমিকরা। বৈশ্বিক বর্তমান পরিস্থিতিতে ন্যূনতম মজুরিতে তাদের বেঁচে থাকাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে । তাই ‘কাজে না গেলে মজুরিহীন অবস্থায় অভুক্ত থাকার’ ঝুঁকি নিয়েও লাখো শ্রমিক আন্দোলনে নেমেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রেও ১৬৭টি বাগানের প্রায় ৭ লাখ চা শ্রমিক বঞ্চিত।

একজন শ্রমিক দৈনিক ২৩ কেজি চা পাতা চয়নের পর নির্ধারিত ১২০ টাকা মজুরি পান। এরপর বাগানভেদে বাড়তি প্রতি কেজি চা পাতা চয়নে আড়াই থেকে ৫ টাকা মিলে। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বর্তমান মজুরি কার্যকর হওয়ার আগে চা শ্রমিকরা ১০২ টাকা করে মজুরি পেতেন। সেই সময় পণ্য মূল্য এখনকার সময়ের তুলনায় অনেক কম ছিল। তারপরও সংসার চালানো সম্ভব হতো না বলে জানান দলদলি চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মিন্টু দাস।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পংকজ কন্দ বলেন, ২০১৯ সালে যখন সর্বশেষ মজুরি নির্ধারণের সময় চাল ৩০ টাকার কাছাকাছি ছিল। এখন তা ৬০ টাকা। ২০২১ সালের পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা ৩শ টাকা মজুরির কথা বলেছিলাম। এখন যে পরিস্থিতি তাতে ৩শ টাকাও কম হবে। চা শ্রমিকদের নায্য দাবির প্রতি কারও দরদ নেই।

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular