Sunday, September 8, 2024
Homeফিচারনয়াদিল্লিতে ৬ সেপ্টেম্বর হাসিনা-মোদি বৈঠক: ১২ বিষয়ে হতে পারে সমঝোতা

নয়াদিল্লিতে ৬ সেপ্টেম্বর হাসিনা-মোদি বৈঠক: ১২ বিষয়ে হতে পারে সমঝোতা

আগামী ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরেও আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আলোচনা করবেন দুই সরকারপ্রধান। সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সহযোগিতার নতুন খাত নিয়ে আলাপ করবেন তারা।

দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সীমান্ত চলাচল ও যোগাযোগ, পানি, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, সীমান্ত হত্যা, প্রযুক্তি, রোহিঙ্গাসহ বিষয়ে আলোচনা হবে। কমপক্ষে ৮ থেকে ১২ বিষয়ে দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন ঢাকা-নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দুদেশের শীর্ষ প্রধানের বৈঠক সফল করতে দুপক্ষের কূটনীতিকরা কাজ করছেন। সব ঠিক থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লি যাবেন।

ওইদিন নয়াদিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে সফররত প্রধানমন্ত্রী দেশটির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। পরদিন ৬ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠক শেষে যৌথভাবে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হবে, যেখানে দুপক্ষের মধ্যে চলমান সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়কে এগিয়ে নিতে দুই প্রধানমন্ত্রী কোন কোন ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে।

আসন্ন সফরের শেষদিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজমির শরিফ জিয়ারত করবেন এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ সফরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। কলকাতার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিবঙ্গের সম্পর্ক এখন যে পর্যায়ে তাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত।

শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে ঢাকার পক্ষ থেকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, তিস্তার পানি, পাটপণ্য থেকে শুল্ক প্রত্যাহার, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সক্রিয় সমর্থন, সমুদ্রসীমা, জ্বালানি, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ খাতে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এ সফরের আগেই নয়াদিল্লি থেকে আভাস পাওয়া গেছে, পাটপণ্যের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেবে ভারত। দুপক্ষের বাণিজ্য এগিয়ে নিতে প্রস্তাবিত কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট বা সেপা চুক্তির চুক্তি আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর ঘোষণা আসবে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এ ইস্যুতে অনুমতি দিয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি নতুন এ বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে গত জুন মাসে ভারতের অর্থমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রীকে পৃথকভাবে চিঠি পাঠিয়েছেন। ভারত এ সফরে বাংলাদেশকে কোটাভিত্তিক বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। দুপক্ষের মধ্যে নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতে দীর্ঘ ১২ বছর পর বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে যৌথ নদী কমিশন বা জেআরসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন, গঙ্গার পানি বণ্টন, ছয় নদী মনু, ধরলা, খোয়াই, গোমতী, মুহুরী ও দুধকুমার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর সফরে ঘোষণা আসবে। জ্বালানি ইস্যুতে নেপাল থেকে ভারত হয়ে গ্রিডের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ আনার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ঢাকার পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হবে।

পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের জন্য ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হবে। বিগত ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা বিরোধ সংক্রান্ত হেগের স্থায়ী আদালতে (পারমান্যান্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন বা পিসিএ) বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে। আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বঙ্গোপসাগরের ৫০ বর্গ কিলোমিটারের (কিমি) একটি গ্রে এরিয়া উল্লেখ করা হয়। এই ৫০ বর্গ কিমি গ্রে এরিয়ার পূর্ণ সার্বভৌম অধিকার প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ নয়াদিল্লি সফরে ভারতের কাছে চেয়েছিল ঢাকা। এ ইস্যু নিজেরা আলোচনা করেই নিষ্পত্তি করা হবে ভারত সম্মতিও প্রকাশ করেছিল। এর আগে ২০১১ সালে গ্রে এরিয়াসহ সমুদ্রের মহীসোপান সংক্রান্ত বিষয়ে জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা বিষয়ক কার্যালয়ে (ওশেনস অ্যান্ড ল অব দ্য সি, ইউনাইটেড নেশনস) ভারতের বিপক্ষে আপত্তি দাখিল করেছে বাংলাদেশ। তার আগে ভারত আপত্তি দাখিল করে। সেই আপত্তি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। সামনের সফরে ঢাকার পক্ষ থেকে বিষয়টি তোলা হবে। অন্যদিকে ভারতের পক্ষ থেকে এ সফরে প্রতিরক্ষা খাতের সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন গুরুত্ব পাবে। বিগত ২০১৭ সালে প্রতিরক্ষা খাতে সরঞ্জাম কেনার জন্য ৫০ কোটি ডলারের এলওসি চুক্তি সই করে বাংলাদেশ-ভারত।

নয়াদিল্লি চাচ্ছে, ঢাকা ওই ঋণের অর্থ ব্যবহার করুক। ঋণের অর্থ কীভাবে ব্যয় হবে, কোন কোন প্রতিরক্ষাসামগ্রী কেনাবেচা হবে, সহযোগিতার ক্ষেত্র কোথায়, কীভাবে বাড়ানো হবে, এ বিষয়ে দুপক্ষের মধ্যে ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ চুক্তিও হয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের সেনাপ্রধান গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সফর করেছেন। এরপর চলতি আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে চতুর্থ প্রতিরক্ষা সংলাপে যোগ দিতে ভারত সফর করেছেন।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি আ ন ম মুনীরুজ্জামান বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা খাতে সরঞ্জাম কেনার জন্য ৫০ কোটি ডলারের যে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই করেছে তা এখনও সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি। তাই ওই চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকে কী আছে তা না দেখে বলা যাবে না।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ-ভারত দুপক্ষের মূল ভিত্তি হচ্ছে রাজনৈতিক আস্থা ও বিশ^াস। দুদেশের নেতাদের মধ্যে এ আস্থার সম্পর্ক শক্তিশালী হওয়াতেই অতীতের যেকোনো সময় থেকে এ সময়ের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অনেক বেশি শক্তিশালী। দুপক্ষই এ সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চায় এবং সম্পর্কের নতুন ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের এই যে বিজয় (মুক্তিযুদ্ধ), বাংলাদেশের এই বিজয়ের জন্য ভারত রক্ত দিয়েছে। আর আজকে আমাদের বিজয়ের দিনে ভারতও যৌথভাবে এই উদযাপন করেছে। এটা বড় পাওয়া, এটা প্রমাণ করে যে এটা রাজনৈতিক পরিপক্বতা এবং কূটনৈতিক পরিপক্বতা।’

ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত বছরের ৪ মার্চ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও একটি মূল প্রতিবেশী এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করি। দুদেশের সম্পর্কের প্রতিটি অর্জন এ অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। আমরা অন্যদের কাছে এ সম্পর্ককে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত করি।’

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স (আইসিডব্লিউএ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক মঙ্গলবার বলেন, ‘দুদেশের শীর্ষ নেতার মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক থাকায় আসন্ন ভারত সফরে ইতিবাচক ফল আসবে এবং অনিষ্পন্ন অনেক ইস্যুর সুরাহা হবে। আমি আশাবাদী, এ সফর সফল হবে।’

ওই একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার, দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমানে দেশটির পক্ষে জি-২০ মুখ্য সমন্বয়ক হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, ‘ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের পাশাপাশি বাংলাদেশকে সহজ শর্তে ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত, যা দুপক্ষের মধ্যে আস্থা ও সমঝোতা বাড়ার পথ আরও সুগম করবে।’

আ ন ম মুনীরুজ্জামান গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আসন্ন সফরে দুদেশের মধ্যে যে অনিষ্পন্ন ইস্যু রয়েছে, সেসব ইস্যুতে সমাধান আসবে বলে আশা করি। বিশেষ করে নদীর পানি বণ্টন এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধ ইস্যুতে।’

এর আগে, গত ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী সর্বশেষ ভারত সফর করেন। ওই সফরে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাদশাহী পোলাও থেকে শুরু করে চেন্নাইয়ের মালপোয়াসহ হরেক রকমের আড়ম্বরপূর্ণ ভেজিটেরিয়ান খাবার দিয়ে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়ন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এমন সময়ে ‘তুমকো দেখাতো ইয়ে খেয়াল আয়া’, ‘একলা চলোরে’ এমন ধরনের পুরনো ক্লাসিক গান বাজছিল।

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular