Sunday, September 8, 2024
Homeফিচারঘুষে অতিষ্ঠ মালিক বিক্রি করে দিলেন লঞ্চ

ঘুষে অতিষ্ঠ মালিক বিক্রি করে দিলেন লঞ্চ

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআইডব্লিউটিএর বিভিন্ন দপ্তরে ঘুষ ছাড়া নড়ে না ফাইল। রুট পারমিট থেকে শুরু করে ফিটনেস সনদ দাখিলকারী দপ্তরের টেবিলে টেবিলে আগেই ঘুষের টাকা পরিশোধ করলে তবেই মেলে সনদ। আগে ‘টেবিলের নিচ’ দিয়ে যেখানে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করেই মিলত সনদ; এখন সেই ঘুষের টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিলে সব ঠিক; না দিলে সনদ তো মেলেই না; উল্টো মামলা-হামলারও শিকার হতে হয় ব্যবসায়ীদের।

লঞ্চ পানিতে ভাসাতে গিয়ে পদে পদে ঘুষ গুনে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। এসব বিষয়ে ভুক্তভোগীরা বহুবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ জানিয়েছেন, কিন্তু কাজ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই বেচে দিয়েছেন আয়ের একমাত্র অবলম্বন শেষ লঞ্চটিও। একাধিক লঞ্চ মালিকরাও হাঁটছেন একই পথে। সর্বশেষ ‘মেসার্স আয়েশা আরিফা শিপিং লাইন্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্ব¡াধিকারী মো. আলাউদ্দিন খন্দকার বেচে দিতে বাধ্য হয়েছেন রাসেল-৫ নামের একটি লঞ্চ। এরই কিছুদিন আগে ঘুষের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে তিনি ২৮ লাখ টাকা গচ্চা দিয়ে বেচেছেন এমভি নিউ-আরিফ লঞ্চটিও। কর্মকর্তাদের ঘুষ বিনিময়ে অতিষ্ঠ হয়ে ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন অভিযোগ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। উল্টো নাজেহাল হতে হয়েছে তাকে। গতকাল রবিবার ভুক্তভোগী একাধিক লঞ্চ মালিক বিআইডব্লিউটিএতে পদে পদে ঘুষের সবিস্তারে জানান আমাদের সময়কে।


ঝামেলা এড়াতে তারা নাম প্রকাশ না করতে শর্ত জুড়ে দিলেও বছরের পর বছর ধরে চলা এই অন্যায়ের বিষয়ে মুখ খুলেছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন খন্দকার। তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিএতে ঘুষবাণিজ্যের নেপথ্যে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম।


ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ভিত্তিহীন, মনগড়া দাবি করে গতকাল বিকালে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, অভিযোগ যে কেউই কারও বিরুদ্ধে দিতে পারে। তবে এর বিচার করবে সরকার। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে তার প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি, পারবেও না। কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে তিনি জড়িত নন বলেও দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

বিআইডব্লিউটিএতে বেপরোয়া ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে গত ৭ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ- নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক রফিকুল ইসলাম ঢাকা-ইলিশা ভায়া চাঁদপুর রুটে চলাচলকারী রাসেল-৫ লঞ্চের ফিটনেস থাকার পরও যাত্রী পরিবহনে রুট পারমিট ও সময়সূচি দিচ্ছেন না। কিন্তু ঘুষবাণিজ্যের মাধ্যমে অন্যান্য লঞ্চকে রুট পারমিট ও সময়সূচি দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা জানতে গত ১৮ জুলাই ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন খন্দকারকেও এক নোটিশের মাধ্যমে তলব করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত সচিব সদস্য (অর্থ) আবদুছ ছাত্তার শেখ। নোটিশের তিনদিন পরই ঘুষের বৃত্তান্ত তুলে ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জবাব দেন ভুক্তভোগী ওই ব্যবসায়ী।

আলাউদ্দিন খন্দকার জানান, এমভি রাসেল-৫ নৌযানসহ তার আরও ২টি নৌযান ঢাকা-চাঁদপুরসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চলাচল করত। বাংলাদেশে কোভিড ১৯-এর কারণে প্রায় এক বছর নৌযান বন্ধ ছিল। এতে চরমভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লেও দীর্ঘদিন নৌযানের শ্রমিক/কর্মচারীদের বেতন ভাতা পরিশোধ করতে হয়েছে তাকে। ওই ব্যবসায়ী রাসেল-৫ লঞ্চটি সময়সূচিী ও লাইনবিহীন (রুট) অবস্থায় কেনার পর ৫০ লাখ টাকা খরচ করেন। নৌযানটি নদীপথে চলার উপযোগী হলে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক রফিকুল ইসলাম বরাবর ঢাকা-ইলিশা ভায়া চাঁদপুরে সময়সূচি ও লাইন চেয়ে আবেদন করেন আলাউদ্দিন। কিন্তু আবেদনটি পরিচালক আইনগতভাবে নিষ্পত্তি না করে নীরব থাকেন। পরে আলাউদ্দিন অফিসে গিয়ে দেখা করলে পরিচালক রফিকুল ওই ব্যবসায়ীর কাছে নৌরুট সময়সূচি ও লাইনের জন্য ৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। এতে সায় না দিলে নৌযানটি পানিতে আর নামবে না বলেও জানিয়ে দেন পরিচালক। গত ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকা দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের চাপ থাকার পরও ঘুষ না পেয়ে নৌযানের রুট পারমিট দেননি তিনি। অথচ অনেক নৌযান মালিকদের মোকদ্দমাজনিত কারণে সময়সূচি স্থগিত থাকার পরও তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়ে নতুন সময়সূচি দিয়েছেন। রফিকুল ইসলামের এসব বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিষয়ে একাধিকবার প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দপ্তরে জানিয়েছেন; কিন্তু কাজ হয়নি।

ওই ব্যবসায়ী তলবী নোটিশের জবাবেও জানান, আদালতের আদেশও মানেন না ওই পরিচালক। দেওয়ানী মো. নং- ৭৪/২২ মেসার্স আয়েশা আরিফা শিপিং লাইন্সের (তারিখ- ১৬/০৫/২০২২) পত্র মোতাবেক আদালতের আদেশ মোতাবেক কার্যকর করেননি তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে দরখাস্তকারী ওয়াসিম প্রতিবাদ করায় রফিকুল ইসলাম তাকেও ডেকে নিয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। ঢাকা নৌ-বন্দরের মালিক সমিতির সিদ্ধান্ত, বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ সমিতির সুপারিশ ছাড়া কোনো নৌযান মালিকের সময় প্রদান করা যাবে না। অথচ রফিকুল ইসলাম গত ২৯ জুনের পরও রহস্যজনক কারণে সমিতির সুপারিশ ছাড়া ঈদের আগে বেশ কয়েকটি নৌযানকে সময়সূচি প্রদান করেন। ওই পরিচালকের অত্যাচারে কয়েক কোটি টাকা লোকসান গুনে পথে বসার উপক্রম হয়েছে।

অশ্রুশিক্ত চোখে আলাউদ্দিন খন্দকার বলেন, ‘আমি রফিকুল স্যারের দুই পা জড়িয়ে ধরে বলছি- স্যার আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি তা হলে আমাকে মাফ করে দেন। তারপরও মন গলেনি তার। তিনি আমাকে সাফ জানিয়ে দেন, ৫ লাখ টাকা ঘুষের কথা চেয়ারম্যানকে জানিয়েছিস। ভালো করিস-নি। তোর লঞ্চ আমি কখনই পানিতে ভাসাতে দেব না। লঞ্চ ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে পদে পদে ঘুষের সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান ভুক্তভোগী এই ব্যবসায়ী।

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular