জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ দলের সম্মেলন আহ্বান করার পর একদিন পর এবার তাকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তার দলের বেশিরভাগ এমপি। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে। চিঠিতে দলের বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম কাদের) বিরোধীদলীয় নেতা করার প্রস্তাব করা হয়।
গত বুধবার রওশন এরশাদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আগামী ২৬ নভেম্বর দলের কাউন্সিল আহ্বান করেন এবং নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করে আট সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেন। কিন্তু কমিটিতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম কাদের) রাখা হয়নি। তখন চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার প্রধান পৃষ্ঠপোষকের নেই।
এর একদিন পর গতকাল সন্ধ্যায় তাকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে দলটির মহাসচিব সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু স্পিকারকে চিঠি দেন। এর কয়েক ঘণ্টা আগে গতকাল দুপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, জাতীয় পার্টি কোনো ষড়যন্ত্রে মাথানত করবে না।
জাতীয় পার্টির বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, স্পিকারকে চিঠি দেওয়ার আগে জাতীয় পার্টির টিকিট নিয়ে নির্বাচিত ও সংরক্ষিত আসনের ২৬ সংসদ সদস্যের মতামত নেওয়া হয়। এতে রওশনকে বিরোধী দলের নেতার আসন থেকে সরানোর পক্ষে ২৪ জন মত দেন এবং চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। সেলিম ওসমান ও শাদ এরশাদসহ তিনজন তাতে সম্মতি দেননি।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা অনেকদিন ধরে অসুস্থ। তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে সংসদেও ঠিকমত আসতে পারছেন না। এজন্য সংসদীয় দল এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠক করেছি আমরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সিদ্ধান্তের কথা স্পিকারকে জানিয়েছি। ওই বৈঠকে ২৬ জন এমপির মধ্যে ২৩ জন উপস্থিত ছিলেন এবং একজন টেলিফোনে তার সম্মতির কথা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার সভাপতিম-লীর এক সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, এর আগে অর্থাৎ বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ এমপি এই সিদ্ধান্তে ঐকমত্য ছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত রওশন এরশাদকেই বিরোধীদলীয় নেতা করা হয়। কেন জাপার এমপিদের মতামতকে আমলে নেওয়া হয়নি, সেটি আজও অজ্ঞাত।
জাতীয় পার্টিতে হঠাৎ এমন অস্থিরতায় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ হতাশ। জাপার এক নেতার ভাষ্য- জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই জাতীয় পার্টিকে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। দলের মধ্যে দুটি ভাগে ভাগ করিয়ে অদৃশ্য সুতোর টানে দলটিকে নাচানো হয়।
জানা গেছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায় দলের পরবর্তী চেয়ারম্যানের নাম হিসেবে জিএম কাদের নিজের নাম ঘোষণা করেছিলেন। এ নিয়ে দলে বিরোধ দানা বাধে। পরবর্তী সময়ে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জিএম কাদের দলটির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বেশ ভালোই চলছিল। জিএম কাদের দায়িত্ব পাওয়ার পর রওশন এরশাদের দোয়া নিতে গিয়েছিলেন। পরে রওশন খুব অসুস্থ হয়ে গেলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে থাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ সাত মাস চিকিৎসা শেষে জুন মাসে দেশে আসেন। সেখানে তাকে জিএম কাদেরসহ দলের নেতাকর্মীদের স্বাগত জানাতে দেখা যায়। দেশে ফিরে একটি সভাতেও বক্তব্য দিতে যান রওশন। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও কিছু অভিমান প্রকাশ করেন। এরশাদের অবর্তমানে দলটি ভালো নেই বলেও বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। তবে এই অভিমান দলে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।
গত বুধবার বিকালে রওশন একটি বিবৃতির মধ্য দিয়ে দলটির সম্মেলনের ডাক দেন। অন্যদিকে জিএম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, দলের সম্মেলনের ডাক দেওয়ার এখতিয়ার তার (রওশনের) নেই। এ নিয়ে দলে ও দলের বাইরে ব্যাপক আলোচনা হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার জিএম কাদের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত। গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে যাবে দলটি। কোনো ষড়যন্ত্রই জাতীয় পার্টির ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারবে না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সৈনিকরা ষড়যন্ত্রে কখনই বিভ্রান্ত হবে না। কোনো ষড়যন্ত্রে মাথানত করবে না জাতীয় পার্টি। সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’
গতকাল দুপুরে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জাপা চেয়ারম্যান এ বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত ছিলেন দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা, সুনীল শুভরায়, মীর আবদুস সবুর আসুদ, মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, আলমগীর সিকদার লোটন, জহিরুল ইসলাম জহির, মোস্তফা আল মাহমুদ, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা শেরীফা কাদের, ড. নুরুল আজহার শামীম, মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, হেনা খান, নাজনীন সুলতানা, ভাইস চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান খান, শফিকুল ইসলাম শফিক, শফিউল্লাহ শফি, জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, এইচএম শাহরিয়ার আসিফ, মো. জসীম উদ্দিন ভূঁইয়াসহ অনেকে।
এই অনুষ্ঠানের প্রায় ৬ ঘণ্টা পর বেশিরভাগ এমপির সম্মৃতি নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে রওশনকে সরানোর চিঠি জাতীয় সংসদের স্পিকারের হাতে দেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।