দ্য কনভারসেশনে রবিবার প্রকাশিত প্রবন্ধে ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা গবেষক আলান্না হারম্যান, টিম এলকমব ও আলান হার্ডম্যান বলেছেন, ব্যক্তিগত খেলোয়াড়ি নৈপুণ্যের নাটকীয় বিপর্যয় যেমন দেখা গেছে, একই সঙ্গে অনন্যসাধারণ ফুটবলও আমরা দেখেছি। প্রবন্ধটি বাংলায় প্রকাশের অনুমতি গ্রহণ ও অনুবাদ করেছেন আমাদের সময়-এর সহকারী সম্পাদক জাহাঙ্গীর সুর
ফুটবলে মেতে ছিল বিশ্ব। এক মাস ধরে। কাতারে পুরুষদের ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ আসর ফুরিয়েছে। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ৩-৩ গোলে ড্র হওয়ার পর আর্জেন্টিনা ফ্রান্সকে ৪-২ গোলে পেনাল্টি শুটআউটে পরাজিত করে। কাতারের রাজধানী দোহার ঠিক বাইরে লুসাইল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত নখ-কামড়ানো ফাইনাল ম্যাচের দর্শক-ভক্ত ছিল রেকর্ডসংখ্যক।
এবারের আসরে গ্রপপর্ব ছিল অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। যেসব দল নকআউট পর্বে উঠেছিল, এতে বৈশ্বিক প্রতিনিধিত্ব আগের সব আসরের চেয়ে বেশি ছিল। ব্যক্তিগত খেলোয়াড়ি নৈপুণ্যের নাটকীয় বিপর্যয় যেমন দেখা গেছে, একই সঙ্গে অনন্য সাধারণ ফুটবলও আমরা দেখেছি। বিশেষ করে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি খেলোয়াড় লিওনেল মেসি এবং ফ্রান্সের উদীয়মান মহাতারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে এই আসরকে অনন্য করে তুলেছেন।
২০১০ সালে ফিফা ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণা করেছিল। ঠিক সেই সময় থেকেই ক্রীড়াজগতের বাইরেও বহুমুখী বিতর্ক এ আসরকে জর্জরিত করে আসছে। ফিফা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ তো ছিলই। কিন্তু যে দেশের ফুটবল ইতিহাস বলার মতো নয়, বিশ্বকাপ আসর আয়োজনে পরিকাঠামোসহ ওরকম একটা ছোট্ট জাতির সক্ষমতা বা উপযুক্ততা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
মরুর দেশ কাতারের কাঠফাটা গ্রীষ্ম তর্ককে তাতিয়ে তুলেছিল। কারণ ফিফার আসর বসে সাধারণত জুন-জুলাইয়ে। কিন্তু কাতারে সেই স্বাভাবিক ও প্রচলিত সূচি অবাস্তব-অসম্ভবপর ছিল। সূচি ঠেলে পাঠানো হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে। এই অগত্যা সূচি-চ্যুতিকে ইউরোপের ফুটবল সংঘগুলো তাদের নিয়মিত সূচির বিপর্যয় বলে অভিহিত করে মন ভারী করেছিল।
খেলা ও রাজনীতি
উল্লিখিত তর্কগুলোর বাইরে, ২০২২ বিশ্বকাপ সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে পরীক্ষিত ক্রীড়া আসর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এবারের বিশ্বকাপের সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতির কীরূপ সম্পর্ক ছিল, তা বোঝানোর জন্য কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। এলজিবিটি অধিকার আন্দোলনের সমর্থনে কোনো দলের অধিনায়ক ‘অয়ান লাভ’ বাহুবন্ধনী পরিধান করলে তাকে হলুদ কার্ড দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল ফিফা।
কাতারি সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে জার্মান খেলোয়াড়রা ম্যাচ শুরুর আগে ছবি তোলার সময় তাদের মুখ ঢেকে রেখেছিল। বেলজিয়ানদের কাছে মরক্কোর পরাজয়ের পর উত্তর আফ্রিকার দেশটির কিছু ভক্ত বেলজিয়ামে দাঙ্গা করেছিল। সার্বিয়ান খেলোয়াড়রা তাদের লকার রুমে স্বদেশের একটি মানচিত্র প্রদর্শন করেছিল, যে মানচিত্রে কসোভোকে সার্বিয়ার অংশ হিসেবে দেখানো হয়। আর সেখানে লেখা ছিল- ‘আত্মসমর্পণ নয়’। কসোভো ২০০৮ সালে সার্বিয়া থেকে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। মার্কিন সকার ফেডারেশন ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতীক ছাড়াই সামাজিক মাধ্যমে ইরানির পতাকার একটি ছবি প্রদর্শন করার পর ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আসর থেকে বের করে দেওয়ার আহ্বান জানায়। স্টেডিয়ামে সরকারপন্থি ও সরকারবিরোধী প্রতিবাদী ইরানি ভক্তদের মধ্যে সংঘাত বাধার শঙ্কা ছিল। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি ছিল না অনেক ফুটবল ভক্ত। দল ও ভক্তরা ফিলিস্তিনের পতাকা উঁচিয়ে ধরেছিল খেলার দিন। আলবেনীয় বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় খেলানোয় সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে সার্বিয়ার ম্যাচের সময় মাঠে ও স্ট্যান্ডে উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছিল।
মানবাধিকারের সমালোচনা
সমকামিতা নিষিদ্ধে যে আইন করেছে কাতার এবং অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করেছে দেশটি, এ নিয়ে কড়া সমালোচনায় সরব ছিল মানবাধিকার সংস্থাগুলো। কাতারে লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিক বাস করে। এদের মধ্যে আনুমানিক ১০ লাখ শ্রমিক নির্মাণশিল্পে নিযুক্ত।
দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিফা যেদিন থেকে কাতার বিশ্বকাপ আসরের ঘোষণা দিয়েছে, এর পর থেকে কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে সাড়ে ছয় হাজার প্রাণ হারিয়েছে। নিহত শ্রমিকদের বেশিরভাগই দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক।
কাতারি কর্তৃপক্ষ অবশ্য দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। দোহার দাবি, অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না, বরং সঙ্গতিপূর্ণই ছিল। কাতারি কর্মকর্তারা উল্টো ফিফার আশাবাদী অতীতের প্রসঙ্গ টেনে দাবি করেছিল, এই বিশ্বকাপ কাতারকে আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে একটি বৈচিত্র্যময় অর্থনীতি হওয়ার সুযোগ দেবে; শ্রম সংস্কারসহ দুর্বল অভিবাসী শ্রমিকদের আরও ভালোভাবে সুরক্ষা দেওয়ার মতো সামাজিক অগ্রগতির নেপথ্যের শক্তি জোগাবে এই বিশ্বকাপ আসর।
আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, আমেরিকান অভিনেতা মরগান ফ্রিম্যান গনিম আল মুফতাহর সঙ্গে মাঠে হাজির হন। সামাজিক মাধ্যমে কাতারের জনপ্রিয় মুখ গনিমের জন্ম হয়েছিল মেরুদ-ের দুর্বলতা নিয়ে। ফ্রিম্যান তার সঙ্গে মাঠে এসেছিলেন এই বার্তা দিতে যে, বিশ্ব আসলে ‘একটি একক ও বৃহত্তর সমাজ’। ওই অনুষ্ঠানে কাতারের আমির, শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বিশ্বকে তার দেশে স্বাগত জানান। ‘যা তাদের বিভক্ত করে তা একপাশে রেখে’ জনগণকে ‘মানবীয় ও সভ্য যোগাযোগে’ মন দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কাতারি নেতার এই মৃদু সুর কিন্তু ঠিক আগের দিনের কঠোর সুরের পুরো বিপরীত। আগের দিন তিনি ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর সঙ্গে আলাপকালে বেশ চটেছিলেন। রাগের সুরে ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় তিনি পশ্চিমাবিশ্বের ভণ্ডামি নিয়ে কথা তুলেছিলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ইউরোপকে আগামী তিন বছরের জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেছিলেন।
পুরো আসরজুড়েই, বিশ্ব রাজনীতি ও বিশ্বকাপের এই সব সংযোগ-সংঘাতই বলা ভালো- নিয়ে আমরা নজর রাখছিলাম। যেন প্রতিটি ম্যাচই ছিল আন্তর্জাতিক বিষয়ের একেকটি গল্প। কখনো সরাসরি ফুটবলের মাধ্যমে, আবার কখনো স্পর্শকাতরভাবে। এ কথা তো স্বীকার করতেই হবে, খেলাধুলা সর্বদাই স্থান-কালের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। রাজনীতির বাইরে থেকে বিশ্বকে আরও ভালো করার কথা যারা বলে, ফিফার মতো সেই দ্বাররক্ষীরা যতই অনুরোধ করুক না কেন, মানতেই হবে, রাজনৈতিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যায় না বা একপাশে রাখা যায় না।