কার জন্য ঝুঁকি নিয়েছিলেন শরীফ উদ্দিন

0
145

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দিন কি নিজের জন্য বড় প্রকল্পে জড়িত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করেছিলেন? নাকি দুদকের অনুমোদন সাপেক্ষে রাষ্ট্রের জন্য করেছিলেন। রবিবার দুদক সচিবের সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে সবার মনে এই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) শরীফ উদ্দিন যদি নিজের জন্য এত বড় ঝুঁকি নিতেন তাহলে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে উল্টো দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি কি তা করেছেন। সচিবের বক্তব্যে থেকে তারও প্রমাণ মেলেনি।

বয়সে তরুণ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক যে ১৩টি অভিযোগ এনেছে, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- শরীফের অনুসন্ধান ও তদন্তের কাজ ছিল একটি সিস্টেমের মধ্যে। সেটি কী- এমন প্রশ্নের সরল উত্তর হলো, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেলে দুদক ঝাঁপিয়ে পড়ে না। অভিযোগ আসে নানা মাধ্যম থেকে। তবে বেশিরভাগ অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির খবর থেকে।

এর পর সে অভিযোগ অনুসন্ধানযোগ্য কিনা বা অনুসন্ধান করলে সুফল আসবে কিনা তা বিবেচনায় রেখে সে বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অনুসন্ধানে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর সদরদপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট জেলা বা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে পাঠানো হয়। বিধি অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হয় তদন্তকারী কর্মকর্তা। আর ওই কর্মকর্তার ওপরে থাকেন একজন তদারককারী কর্মকর্তা।

চট্টগ্রাম দুদক কার্যালয়ের জন্য একজন পরিচালক, তদারককারী কর্মকর্তা, তাদের মাঝে একজন ডেস্ক অফিসার দায়িত্বে আছেন। অর্থাৎ প্রধান কার্যালয় থেকে শাখা কার্যালয় পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে এবং কয়েকটি টেবিল হয়ে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার হাতে আসে অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট চিঠি ও অনুসন্ধান সম্পর্কিত নথি। দুদকের বিধি মোতাবেক অনুসন্ধানের প্রতিটি স্তরের খবর বা তথ্য তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাতে হয়।

কাউকে নোটিশ করা, জিজ্ঞাসাবাদ করা, কোনো আলামত জব্দ করা- সবকিছুই ঊর্ধ্বতনদের অবহিত না করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি শাখা অফিস হয়ে প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত গড়ায়। এত সব নিয়মকানুনের মধ্যেই শরীফ বা তার মতো কর্মকর্তাদের কাজ করতে হয়।

প্রশ্ন হলো এতগুলো ঘাট পাড়ি দিয়ে শরীফ যখন রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতি এবং কক্সবাজারের দুটি উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করে মামলা এবং চার্জশিটের সুপারিশ করেন তখন হঠাৎ করেই প্রতিপক্ষ হয়ে গেলেন শরীফ। শুধু অভিযুক্তরাই নয় তাদের দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকের কাছেও প্রতিপক্ষ হলেন এই কর্মকর্তা। ফলে দুদক ২০০৮ সালের বিধির ৫৪(২) ধারায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো। আর সেটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এখন নানা ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে দুদক থেকেই। এখন প্রশ্ন হলো দুদক কি একজন শরীফের ওপর সব ছেড়ে দিয়েছিল। তার কোনো কাজের খবর নেয়নি। তাহলে এতদিন এসব প্রশ্ন কেনো সামনে এলো না।

জানা গেছে, রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে প্রাণনাশের হুমকি পান শরীফ উদ্দিন। জনৈক ব্যক্তির হুমকির অভিযোগে গত ৩০ জানুয়ারি থানায় জিডি করেন। তার জিডির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। তদন্তকালে সংগৃহীত সিসিটিভির ফুটেজেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ৫৪(২) ধারা তাদের ওপর এক ধরনের খড়গ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ধারাটি মাথার ওপর ঝুলে থাকায় কর্মকর্তারা সব সময় তটস্থ থাকেন। কারও পক্ষে বা বিপক্ষে অনুসন্ধানের ফলাফল যদি যায় তাহলে এই ধারা দিয়ে তাকে পর্যুদস্ত করা সম্ভব। যেটি হয়েছে শরীফের ক্ষেত্রে। প্রশ্ন হলো এখন শরীফের কী হবে!

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের আইন শাখার সাবেক মহাপরিচালক মাইদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, শরীফ কমিশনের কাছে দরখাস্ত দিতে পারে। কমিশন তা বিবেচনা করে চাকরিচ্যুতির যে আদেশ তা বাতিল করতে পারে। এটি তার বিবেচনা করার এখতিয়ার রয়েছে। শরীফের ইস্যুটি আদালতের হাতে ছেড়ে না দিলেই ভালো হয়। তিনি বলেন, ৫৪ বিধির কারণে কমিশন কর্মকর্তাদের একদিনের চাকরিরও নিশ্চয়তা নেই। এটি ভয়ঙ্কর রকমের খড়গ। বিধিটি বাতিলের জন্য তারা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে লিখতে পারেন। এ ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগ তো রায় দিয়েই দিয়েছেন বাতিল মর্মে। কমিশন চাইলে এখন হাইকোর্টের রায়টি অনুসরণ করতে পারে।

শরীফের কাছে আলামতের ৯৩ লাখ টাকা রাখার বিষয়ে অভিযোগ এনেছে দুদক। বলেছে এটি তার এখতিয়ারবহির্ভূত। এ বিষয়ে মাইদুল ইসলাম বলেন, জব্দকৃত প্রতিটি নোটের নম্বর রেজিস্ট্রারভুক্ত করে তারপরেই ট্রেজারিতে বা কোনো ব্যাংকে রাখতে হবে। না হলে আদালতে আলামত হিসেবে প্রদর্শনের সময় সেই টাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এক্ষেত্রে শরীফের পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকতে পারে। তিনি প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা থেকে রক্ষার জন্য অফিসের আলমারিতে টাকা রেখেছেন বলেই মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে তার চাকরি যাওয়ার মতো গুরুদ-ের ঘটনা আমি দেখছি না। তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, আমি দায়িত্বকালে দেখেছি জব্দ করা টাকা আলামত হিসেবে অনুসন্ধান বা তদন্ত কর্মকর্তার আলমারিতেই রাখা হয়। এটি তাদের এখতিয়ারের মধ্যেই পড়ে। তবে এখানে টাকার অঙ্ক যেহেতু বেশি সেক্ষেত্রে কমিশনকেই দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত ছিল।

মাইদুল ইসলাম বলেন, অনুসন্ধানের সময় যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আসে, তারা প্রায়ই নিজেদের রক্ষার জন্য ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে থাকেন। সেটি সত্য-মিথ্যা দুটিই হতে পারে। তবে শরীফের ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতা থাকলে তিনি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা বা চার্জশিটের সুপারিশ করতেন না। ফলে শরীফের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার যে অভিযোগ এনেছেন অভিযোগসংশ্লিষ্টরা তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বারবার বলছেন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। দুদক কোনো প্রভাব আমলে নেয় না। প্রভাবিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। সচিবের উল্লেখিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- কমিশনের নিয়ম না মেনে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ পরিচালনা করা, অভিযোগসংশ্লিষ্টদের হয়রানি ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন চালানো, আলামত হিসেবে জব্দ করা ৯৩ লাখ টাকা নিজের কাছে রেখে দেওয়া, রিটের ভুয়া আদেশ দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশ করানো, বদলির পর নতুন কর্মস্থলে যোগদানে বিলম্ব করা এবং নথি বুঝিয়ে না দেওয়ার মতো ঘটনা।

দুদক সচিবের আনীত অভিযোগের জবাবে শরীফ উদ্দিন বলেন, অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর নির্দেশিকা না মেনে নিজের খেয়ালখুশিমতো কার্যপরিচালনা করার অভিযোগটি সুনির্দিষ্ট নয়। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের (সজেকা) দায়িত্বে উপপরিচালক (ডিডি) থাকেন। কাউকে তলব করলে নোটিশের কপি ডিডিকে দিতে হয়। অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার সময় কাউকে ডেকে এনে হয়রানি করা হতো, তা সঠিক নয়। বিষয়টি সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণ উপস্থাপনের দাবি জানান তিনি।

এ ছাড়া কক্সবাজারে একজন সার্ভেয়ারের বাসায় অভিযান চালিয়ে টাকা জব্দ করে র‌্যাব। জব্দকৃত আলামতের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা কোষাগারে জমা রাখা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ট্রেজারি থেকে বলা হয়েছে টাকা কাপড়ে মুড়িয়ে ট্রাংকে রাখা হয়। তারা টাকা নয়, একটি ট্রাংক পেয়েছেন মর্মে রিসিভ করবেন। ট্রাংকে কী আছে, তা উল্লেখ থাকবে না। আমি প্রমাণ ছাড়া টাকা ব্যাংক রাখার পক্ষপাতি ছিলাম না। এ ছাড়া হাইপ্রোফাইলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করায় তাকে প্রাণনাশের হুমকির বিষয়টি ৬ ফেব্রুয়ারি সচিবকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম।

মাইদুল ইসলাম বলেন, চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দিন তার বক্তব্যে উল্টো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার সময় কাউকে ডেকে এনে হয়রানির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে বলেছেন তিনি। তার মানে হচ্ছে শরীফ উদ্দিন বড় মাপের কোনো অনিয়ম করে থাকলে এত শক্তভাবে কথা বলতে পারতেন না। ফলে কমিশনের উচিত শরীফ উদ্দিনের বিষয়টি আর বাড়তে না দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান করে ফেলা। এটি যত ঝুলিয়ে রাখা হবে, জনমনে কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকবে। এ ছাড়া শরীফের সহকর্মীরা দাবি তুলেছেন ৫৪ বিধিটি বাতিল করতে, এ দাবিতে তারা এখনো অনড় রয়েছেন। ফলে এ বিষয়েও কমিশনকে দ্রুত সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here