বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক ডিসেম্বর মাসে আমানতকারীদের গড়ে বার্ষিক ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ হারে সুদ দিয়েছে। একই মাসে সিটি ব্যাংক দিয়েছে ২ দশমিক ৮২ শতাংশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক দিয়েছে আরও কম, ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে গড়ে ৩ টাকারও কম সুদ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এই সুদ থেকে সরকারের উৎস কর, আবগারি শুল্কসহ নানা রকমের চার্জ কাটা হচ্ছে। ফলে ব্যাংকে টাকা রেখে আমানতকারীদের প্রকৃত অর্থে কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো মূল্যস্ফীতির উচ্চহারে জমানো আসল টাকাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় সরকার ও ব্যাংকের নানা রকম চার্জের চাপে পড়ে আমানতকারীর মুনাফা আরও কমছে। আমানতে কম সুদের পাশাপাশি আবগারি শুল্ক ও উৎস কর কাটার ফলে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা যায়, কোনো গ্রাহক বাণিজ্যিক ব্যাংকে আমানত হিসাবে টাকা জমা রাখলে বছর শেষে যে মুনাফা দেওয়া হবে, তার ওপর উৎস কর কেটে নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আমানতের বিপরীতে বছরে একবার আবগারি শুল্কও কাটা হয়। অন্যদিকে মহামারী করোনায় মানুষের আয় কমে গেছে। অনেক মানুষ বেকারও হয়েছেন। কিন্তু বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যয়, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের চার্জ এগুলোর কিছুই কমেনি। আবার চাল, ডাল, তেলসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামও এখন চড়া। ফলে মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে মানুষের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের জায়গা এমনিতেই সঙ্কুচিত। শেয়ারবাজারে আস্থার সংকট রয়েছে। সঞ্চয়পত্রে নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়েই ব্যাংকে টাকা রাখে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদহার কম হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ বা আমানতকারী কখনো সংগঠিত হয়ে কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। ফলে দিন দিন তাদের সঞ্চয়ের মূল্য কমে যাচ্ছে। এটা কল্যাণমুখী উন্নয়নের পরিপন্থী। এতে ঝুঁকিপূর্ণ খাতসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত শক্তভাবে তাদের নির্দেশনা ব্যাংকগুলোকে মানাতে বাধ্য করা। যদি বাজারে অতিরিক্ত তারল্যও থাকে, তা হলে রিভার্স রেপো করে সেই অর্থ তুলে নেওয়া।
মহামারী করোনার মধ্যেই ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়। এর পর থেকেই আমানতের সুদহার ব্যাপক হারে কমতে শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমানতকারীদের সুরক্ষায় ২০২১ সালের আগস্টে মেয়াদি আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম দেওয়া যাবে না বলে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে আগের তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ক্ষুদ্র আমানতকারীসহ অন্যান্য আমানতকারীর একটি অংশ জীবিকানির্বাহের জন্য ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের সুদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মেয়াদি আমানতে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হারে সুদ দেওয়া হচ্ছে বলে আমানতকারীদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনার পরও ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হারের সঙ্গে সমন্বয় করে আমানতের সুদহার নির্ধারণ করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায়ও আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের উদ্দেশ্যে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, মেয়াদি আমানত এবং সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের প্রফিডেন্ট ফান্ড, অবসরোত্তর পাওনাসহ বিভিন্ন পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত আমানত তহবিলের ওপর সুদ কোনো অবস্থাতেই সর্বশেষ তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে যেন কম না হয়, বরং কিছুটা উচ্চহার নির্ধারণ করা ব্যাংকগুলোর জন্য নিরাপদ হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর মাসজুড়ে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের গড়ে সুদ দিয়েছে ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার আমানতে সুদ মিলেছে ৪ টাকারও কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির আগের মাস জুলাইতে গড় আমানতের সুদহার ছিল ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার কমার এই তথ্যই বলে দিচ্ছে সব ব্যাংক মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে সমন্বয় করে আমানতকারীদের সুদ দিচ্ছে না। বিবিএসের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে যে পণ্য ও সেবা ১০০ টাকা খরচ হয়েছিল, গত ডিসেম্বরে সেই পণ্য ও সেবা কিনতে ১০৬ টাকা ০৫ পয়সা খরচ করতে হয়েছে মানুষকে। যদিও আমানতের সুদহার নির্ধারণে সর্বশেষ তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয়। এটি বিবেচনায় নিলেও অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ। কিন্তু ডিসেম্বরে বেশিরভাগ ব্যাংকের গড় আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির এই গড় হারের চেয়ে অনেক কম ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডিসেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রাইম ব্যাংক ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ইস্টার্ন ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ৩ শতাংশ, সীমান্ত ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ, ট্রাস্ট ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ, পূবালী ব্যাংক ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়া ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ ও উত্তরা ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও অগ্রণী ব্যাংক ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। এ সময়ে বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো নামমাত্র সুদে আমানত সংগ্রহ করে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংক এনএ ডিসেম্বর মাসে দশমিক ২২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক দিয়েছে দশমিক ৪৫ শতাংশ, উরি ব্যাংক দশমিক ৪৮ শতাংশ, এইচএসবিসি দিয়েছে দশমিক ৯১ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ২ দশমিক ২০ শতাংশ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ২ দশমিক ২৪ শতাংশ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ ও ব্যাংক আল ফালাহ ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
আমানতের মুনাফা থেকে গ্রাহকের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকলে ১০ শতাংশ এবং টিআইএন না থাকলে ১৫ শতাংশ হারে উৎস কর কেটে রাখা হয়। উৎস করের পাশাপাশি কাটা হবে আবগারি শুল্কও। এক লাখ এক টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে আমানত হলে প্রতিবছর ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা, ১০ লাখ টাক থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত স্থিতির ব্যাংক হিসাবের ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক তিন হাজার টাকা। এক কোটি টাকার বেশি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত স্থিতির ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক ১৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া পাঁচ কোটি টাকার বেশি স্থিতির ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক ৪০ হাজার টাকা।