মহামারী করোনার ধকল কাটিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল হওয়ার পাশাপাশি গত অক্টোবর থেকে নির্মাণ খাতে প্রাণ ফিরতে শুরু করলেও তাতে বাদ সেধেছে নির্মাণসামগ্রীর চড়া বাজার। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে রডের দাম। দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো রডের টন ৯০ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। একইভাবে লাফিয়ে বাড়ছে ইট, পাথর, বালুর দামও। বাড়তি বাজারে সিমেন্টের দাম আরও বাড়াতে চায় উৎপাদনকারীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দুই বছরের ব্যবধানে ভবন নির্মাণের ব্যয় লাগামহীনভাবে বেড়েছে। কেবল রড, সিমেন্ট, ইট, বালু, পাথর নয়; একই সঙ্গে থাই অ্যালুমিনিয়াম, গ্রিল-রেলিং, ইলেকট্রনিক ও স্যানিটেশনসামগ্রীর দামও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। বাড়তি ব্যয়ের চাপে ভবন নির্মাণকাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে। ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে, বিক্রিও কমছে। এতে বিপাকে পড়েছেন নির্মাণ খাতে জড়িত ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে স্বল্প সঞ্চয়ীদের বাড়ি নির্মাণের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
লাগাতার বাড়তে থাকা নির্মাণ খরচের চাপ কুলিয়ে উঠতে না পেরে স্বপ্নের বাড়ি তৈরির কাজ শুরুর আগেই থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন রাজধানীর সবুজবাগ দক্ষিণগাঁও এলাকার বাসিন্দা নুরু মোহাম্মদ গাজী। পেশাজীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে সাড়ে তিন কাঠা জমিতে বসবাসের জন্য বাড়ি নির্মাণের কাজ হাতে নিয়ে কেবল ফাউন্ডেশন পর্যন্তই থেমে যেতে হয়েছে।
আমাদের সময়কে নুরু মোহাম্মদ বলেন, ধারণা করেছিলাম সব মিলিয়ে ৪৫ থেকে ৪৮ লাখের মধ্যে ভবনের ফাউন্ডেশন শেষ করতে পারব; কিন্তু নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ হয়ে গেছে ৫৪ লাখের বেশি টাকা।
নুরু বলেন, বাড়ির কাজ শুরুর সময় একেএস রডের টন ৬৮ হাজার টাকায় পেলেও তা মাঝে দাম বেড়ে হয় ৭৫ হাজার টাকা। রডের দাম ৮৮ হাজার ছাড়ানোর পর কাজ থামিয়ে দিয়েছি। এখন দাম ৯০ হাজারে কাছাকাছি। আগে এক ট্রাক ইট ২৭ হাজার ৫০০ টাকায় পেয়েছি। এখন ৩২ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। ট্রাকপ্রতি যমুনা বালুর দাম ৫ হাজার ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, সাড়ে ৬ হাজার টাকার নিচে পাকশি বালু পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর মাঝামাঝি পাথর প্রতি বর্গফুট ১৮৫ টাকায় পেলেও ফেব্রুয়ারিতে কিনেছি ২৪০-২৫০ টাকায়। এত চড়া বাজারে বাড়ি করা সম্ভব না। ফাউন্ডেশন শেষ করেই কাজ থামাতে বাধ্য হয়েছি।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল অ্যাস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশও (রিহ্যাব) বলছে, দেশের বাজারে রড, ইট, বালু, সিমেন্ট, টাইলস, পাথর, থাই অ্যালুমিনিয়াম ও বৈদ্যুতিকসামগ্রী ছাড়াও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্মাণসামগ্রীর বাড়তি এ দাম কুলিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন আবাসন উদ্যোক্তারা। ব্যক্তি উদ্যোগেও যারা ভবন নির্মাণ করছেন তারাও মাঝপথে কাজ থামিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
নির্মাণসামগ্রীর ওপর রিহ্যাবের এক জরিপে উঠে এসেছে, দুই বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রডের দাম। ২০২০ সালে যেখানে এক টন রডের দাম ৬৪ হাজার টাকা ছিল, এখন সেখানে খরচ হচ্ছে সর্বনিম্ন ৮৮ হাজার টাকা। চলতি মাসে যা ৯০ হাজার টাকায় ঠেকেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ দাম। দুই বছর আগে ভালো মানের সিমেন্ট ৪০৫ টাকায় এক বস্তা সিমেন্ট কেনা গেলেও এখন তা ৪৬০ টাকা। দুই বছরের বালুর দাম বেড়ে প্রায় চারগুণ হয়েছে। ইটের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। পাথরের প্রতি বর্গফুটের পেছনেও খরচ ৮০ টাকা বেড়েছে। ২০২০ সালে থাই অ্যালুমিনিয়ামের পেছনে খরচ প্রতি বর্গফুটে ২৫০ টাকা ছিল, এখন খরচ হচ্ছে ৪২০ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে গ্রিল-রেলিং, পিভিসি পাইপ, স্যানিটারি ফিটিংস ও ইলেকট্রনিকসামগ্রীর দামও বেড়েছে।
রিহ্যাবের সহসভাপতি কামাল মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, রড-সিমেন্টসহ সব উপকরণের দাম অস্বাভাবিক পর্যায়ে বাড়ায় অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে আবাসন শিল্প খাতে। ক্রমবর্ধমান দামের কারণে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নির্মাণকাজ। স্থবিরতা নেমে এসেছে এ খাতে। অতিরিক্ত খরচের চাপে অনেক প্রজেক্টের কাজ মাঝপথে থেমে আছে। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে কাজের দীর্ঘসূত্রতা আরও বাড়বে, যা আবাসন উদ্যোক্তাদের জন্য বড় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়। এ কারণে শুধু আবাসন খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বিভিন্ন সরকারি উন্নয়নমূলক কাজেও স্থবিরতা নেমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা হিসাব করে দেখেছি, অতি সম্প্রতি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত রড, সিমেন্টসহ অন্য নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি বর্গফুটে নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে ৩৭০ থেকে ৪০০ টাকা। ৫০/৫০ অনুপাতে ডেভেলপারের খরচ বেড়েছে প্রায় ৭৪০ থেকে ৮০০ টাকা। বাড়তি খরচের কারণে গত দুই বছরে ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। দাম বাড়ায় ফ্লাট বিক্রিও ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
নির্মাণসামগ্রীর অব্যাহত দাম বৃদ্ধিতে আবাসন খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর নির্মাণ খাতবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি। গত বছরের শেষে কমিটি জানিয়েছে, করোনার প্রকোপ কমে আসায় নির্মাণ খাত ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করেছিলেন এ খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা; কিন্তু নির্মাণসামগ্রীর অব্যাহত দাম বৃদ্ধিতে উল্টো বিপাকে পড়েছেন। নির্মাণসামগ্রীর দাম প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এতে খাতসংশ্লিষ্টদের বড় লোকসানে পড়তে হচ্ছে। বর্তমানে মূল্যবৃদ্ধির এ হার ৩০ শতাংশ হয়েছে বলে মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ইকবাল হোসেন চৌধুরী।