গ্যাস সংকটে উৎপাদন বন্ধ শিল্পকারখানায়

0
149

দেশের জ্বালানি খাত কঠিন এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। অধিক আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ায় এবং দেশীয় জ্বালানির উৎস ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসায় সংকট ক্রমশ ঘনীভ‚ত হচ্ছে। গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় সরকার কৌশলে গ্যাসের রেশনিং করে তুলনামূলক অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরবরাহ চেইন ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। বিশেষজ্ঞ-ব্যবসায়ীরা বলছেন, আপৎকালীন সংকট সমাধানের অধিক পরিমাণ এলএনজির জোগান বাড়াতে হবে।

গ্রীষ্মকালীন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গ্যাস সরবরাহ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় অঘোষিত রেশনিং করছে জ্বালানি বিভাগ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ করলে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকছে। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাড়ালে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অর্থাৎ গ্যাস সরবরাহ নিয়ে কঠিন এক টানাপোড়েনের মধ্যে আছে জ্বালানি বিভাগ। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, সংকটকালীন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে গুরুত্বের ভিত্তিতে গ্যাসের জোগান ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে। গ্যাস সংকটের কারণে ইতোমধ্যে সিএনজি স্টেশনগুলোয় রেশনিং বাড়িয়েছে। বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকছে সিএনজি স্টেশনে। এখন অনেকটা অঘোষিত শিল্পকারখানায় রেশনিং করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বুধবার রাত থেকে গাজীপুর, মাওনা, ময়মনসিংহ এলাকায় শিল্পকারখানাগুলোয় পুরোপুরি গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (তিতাস)। ফলে রাত থেকে সারাদিন শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আশুগঞ্জে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করার কারণে গাজীপুরের একটি ডিআরএস বা তিতাসের কন্ট্রোলরুম থেকে গাজীপুর মাওনার দিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলে শিল্পকারখানাগুলো গ্যাস পাচ্ছে না।

গ্যাস সংকটের বিষয়ে কোহিনুর কেমিক্যালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিম আমাদের সময়কে বলেন, গাজীপুর মাওনার দিকে আমাদের যে কারখানা সেখানে বুধবার রাত থেকে কোনো গ্যাস নেই। কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়েই গ্যাসের চাপ কম থাকে। সেখানে বুধবার রাত থেকে পুরোপুরি গ্যাসের সরবরাহ নেই। ফলে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন রমজান মাস। সামনে ঈদ। শ্রমিকদের বেতন-বোনাসসহ নানা আর্থিক বিষয় জড়িত। এই অবস্থায় কারখানা ঠিকমতো উৎপাদন করতে না পারলে সামনের দিনগুলোয় সংকট বাড়বে। রেজাউল করিম ছাড়াও গাজীপুরের একাধিক কারখানা মালিক গ্যাস না পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন আমাদের সময়কে বলেন, কারখানাগুলোয় গ্যাস নেই। আমি পেট্রোবাংলা এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলছে, আশুগঞ্জের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কারণে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। তিনি আমাদের সময়ের প্রতিবেদকের কাছে বিভিন্ন কারখানার গ্যাসের মিটারের ছবি পাঠান। সেখানে দেখা যায় কারখানাগুলোয় গ্যাসের চাপ শূন্যের কোঠায়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার একটি তালিকা পাঠান। নরটেক্স টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড নামক ময়মনসিংহের নিশিন্দা ভালুকার একটি কারখানার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার তালিকা পাঠান। সেখানে দেখা যায়, চলতি মাসের চার তারিখ থেকে গত ৬ তারিখ পর্যন্ত তিন দিনে ২৫ ঘণ্টা ৩১ মিনিট বিদ্যুৎ ছিল না।

উল্লেখ্য, চলতি সেচ মৌসুমে একাধিক সংকট দেখা দিয়েছে সরকারের সামনে। গ্যাস সংকটে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে সেচে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। ফলে বিভিন্ন এলাকায় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসগুলোয় গত কয়েকদিন ধরে হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানি তেলের দাম অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় জ¦ালানি তেলের আমদানি এবং সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা নিয়ে চিন্তিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ফলে এবারের সেচকালীন পরিস্থিতি সরকারের সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে।

বিপিসি বলছে, সাধারণত ফেব্রæয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চার মাস সেচ মৌসুম হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সময় কৃষিকাজে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। একই সঙ্গে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত জ¦ালানি তেল এবং গ্যাসের। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি কৃষকের ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, সেচপাম্পসহ বিভিন্ন কাজে জ¦ালানি তেলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। অব্যাহত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে চাহিদা বেড়ে যায় প্রাকৃতিক গ্যাসেরও।

চলতি সেচ মৌসুমে গ্যাসের সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার ছয়টি গ্যাসক‚পে হঠাৎ করে সংকট তৈরি হওয়ায় গ্যাস সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে গত কয়েক দিন। যদিও এখন স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করেছে শেভরন। এ ছাড়া বিদেশ থেকে প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের একটি এলএনজি কার্গো এসেছে দেশে, যা গতকাল বৃহস্পতিবার রাত থেকে সরবরাহ শুরু করে। ফলে গ্যাস সংকট অনেকটা স্বাভাবিক হবে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এ বছর সব ধরনের জ¦ালানির চাহিদা বেড়েছে দেশে। ২০১৯ সালের মে মাসে সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৯৭ মেগাওয়াট, ২০২০ সালে তা ছিল ১১ হাজার ৯৭৭ মেগাওয়াট। পর্যায়ক্রমে সেটা বেড়ে চলতি বছর সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, জ¦ালানি সরবরাহের সংকটে চাহিদার বিপরীতে এ বছর গড়ে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেশি হওয়ায় এবং দেশের খনিগুলোয় গ্যাসের উত্তোলন কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রেগুলোর চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে নানা টানাপোড়েনের মধ্যে আছে জ¦ালানি বিভাগ। গ্যাসের চাপ কমাতে সিএনজি স্টেশনগুলোকে ছয় ঘণ্টা গ্যাস দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।

সামগ্রিক বিষয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জ্বালানি খাতের সাংবাদিকদের উদ্দেশে এক আলোচনায় বলেন, পুরো পৃথিবীতে এখন জ¦ালানি সংকট চলছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমেরিকা-ইউরোপের বাজারেও জ্বালানির চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ফলে এই পরিস্থিতিতে কারো কাছে টাকা থাকলেই সে জ¦ালানির চাহিদা নিশ্চিত করতে পারবে বিষয়টি এমন নয়। তিনি বলেন, এমন সংকটকালীন মানুষকে জ¦ালানি সাশ্রয়ী হতে হবে। মিতব্যয়ী বা জ্বালানি সাশ্রয়ী হলে সংকট অনেক কমে আসবে।

এদিকে সেচের মৌসুমে গ্যাসের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিদিন এক হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফার্নেস অয়েলের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ চাহিদা ৭০ হাজার ৫০০ মেট্রিন টন ও ডিজেলের ৩০ হাজার ৭০০ মেট্রিন টন। শুধু সেচের জন্য ২০২১ সালে আলাদাভাবে বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়েছে ২ হাজার ৩১৫ মেগাওয়াট, যা ২০২২ সালের জন্য সম্ভাব্য চাহিদা আলাদাভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৩৭৫ মেগাওয়াট। তবে এই সংকটকালীন সবাইকে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহারের আহŸান জানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হচ্ছে।

এ বছর সেচকালীন জ¦ালানি তেল সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা কঠিন হতে পারে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, চলতি সেচ মৌসুমে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসের সরবরাহের অভাবে বন্ধ রয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশে গ্যাসের সংকট চলছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজির পরিমাণও কমেছে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাস সরবরাহ সম্পর্কে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, প্রায় প্রতিনিয়ত দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে এ বছর সেচকালীন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় পিডিবির প্রত্যাশা অনুযায়ী গ্যাসের জোগান দেওয়া যাবে না।

এদিকে সামগ্রিক গ্যাস সরবরাহ নিয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. নাজমুল আহসান গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে বলেন, দু-একদিনের মধ্যেই গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এলএনজি কার্গো বৃহস্পতিবার রাত থেকে সরবরাহ করা শুরু করে। এ ছাড়া শেভরনের ক‚পগুলোও সরবরাহ শুরু করেছে। ফলে এখন আর সংকট থাকবে না। গাজীপুরের কারখানাগুলোয় গ্যাস সংকট হচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকালের দিকে কিছুটা সমস্যা ছিল; বিকালের পর থেকে সেটা ঠিক হয়ে গেছে।

এদিকে একাধিক ব্যবসায়ী ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আমাদের সময়কে বলেন, এই মুহূর্তে সংকট সমাধানে এলএনজির জোগান বাড়াতে হবে। তবে ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের অনুসন্ধান বাড়াতে হবে।

এদিকে শুধু গাজীপুর বা ময়মনসিংহ নয়, খোঁজ নিয়ে জানা যায় মানিকগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, ভালুকায় অধিকাংশ কারখানা গ্যাস সংকটে ভুগছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের অনেক কারখানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রত্যাশা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না কারখানাগুলোয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here