নতুন পেশা খুঁজছেন সমুদ্রজীবীরা

0
80

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, পর্যটনকেন্দ্রের মাত্রাতিরিক্ত পলিথিনসহ বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে ফেলা, নির্বিচারে ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ শিকার এবং সাগরে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূলে মাছ সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে দাদনের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে এলাকা ছেড়েছেন অনেক সমুদ্রগামী জেলে। আবার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অনেকে নতুন পেশা খুঁজছেন। উপকূলীয় এলাকায় মাছ না থাকায় সরকারের ইলিশ উৎপাদনের তথ্যে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জেলেরা।

জরুরি ভিত্তিতে জাটকা সংরক্ষণ, কুসুম জাল ও ছোট ফাঁসের জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ, পর্যটনকেন্দ্রের বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা বন্ধ করা না হলে নিকট ভবিষ্যতে কুয়াকাটাসংলগ্ন সমুদ্র উপকূল একেবারেই মৎস্যশূন্য হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মাছের বদলে পলিথিন : ২৮ বছর ধরে সমুদ্রের সঙ্গে সম্পর্ক জাহাঙ্গীর মল্লিকের (৪৩)। বাপ-দাদার হাত ধরে সাগরে যাওয়া সেই ছোটবেলায়। সোনালি ইলিশকে

ভালোবেসে এই পেশায় এলেও এখন বেরিয়ে এসেছেন এই পেশা থেকে। তিনি জানান, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে যখন সমুদ্রে যেতেন তখন শুধু ইলিশ শিকার করতেন তারা। বড় বড় সাইজের মাছ পেতেন কুয়াকাটা উপকূলীয় এলাকায়। সে সময় ইলিশ ছাড়া অন্য কোনো মাছ তারা শিকার করতেন না। তাদের ইলিশের জালে লইট্টা, তুলার ডাডিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উঠত। সেসব মাছ নৌকায় না তুলে ফেলে দিতেন সমুদ্রের নোনাজলে। স্মৃতি হাতড়ে জাহাঙ্গীর মল্লিক জানান, তারা মূলত খুটা জাল ফেলতেন। প্রত্যেক গোনে গিয়ে মাছ নিয়ে আবার তীরে ফিরে আসতেন। কোনো কোনো সময় এমনও হয়েছে, এক গোনে যে মাছ পেয়েছেন, তার অর্ধেক তুলে বাকি মাছ আর তুলতে পারেননি। জাল কেটে দিয়ে আসা লেগেছে। এখন সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়। সাগরের এত মাছ হারিয়ে গেল কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর জানান, পুরো উপকূলজুড়ে এখন চর আর চর। আগে যেখানে ১০ বাম (এক বাম সমান পাঁচ হাত) পানি ছিল, এখন সেখানে হাঁটুসমান পানি। জাল ফেলার আর কোনো জায়গা নাই। চরের মাঝে মাঝে যে সরু চ্যানেলগুলো আছে সেসব চ্যানেলে জাল পাতলে মাছ পাওয়া যায় না। মাছের বদলে জালে উঠে শুধু পলিথিন আর পলিথিন। পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সব ধরনের পলিথিন, চিপস আর বিভিন্ন পণ্যের পলিথিন নির্বিচারে ফেলা হয় সাগরে। ভাসতে ভাসতে সেগুলো গভীর সাগরে গিয়ে ধরা পরে জেলেদের জালে।

আলাপকালে জাহাঙ্গীর আরও জানান, পেশায় টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই টিকতে পারছেন না। তিনি অভিযোগ করেন, আগে ইলিশের মৌসুম ছিল বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে এই সময়ের মধ্যে দুদফা অবরোধ দেয় সরকার। প্রথম ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন থেকে এক মাস, আবার পরে ৬৫ দিন। তিনি জানান, ২২ দিনের অবরোধ স্থানীয় জেলেরা সবাই মানে। কেউ সমুদ্রে মাছ শিকারে যায় না। কিন্তু একই সময় ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে হাজার হাজার টন মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। অবরোধে দেশের জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটায়, কিন্তু ভারতের জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ায় ইলিশের উৎপাদন বাড়ে না। আর পরবর্তীতে ৬৫ দিনের যে অবরোধ সরকার দিয়ে থাকে, সেটা জেলেদের মেরে ফেলার শামিল। কারণ হিসেবে তিনি জানান, ৬৫ দিনের অবরোধে গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করতে সরকারি নিষেধ রয়েছে। কিন্তু যারা খুটা জালে উপকূলের দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে মাছ শিকার করেন, তাদের কী কারণে মাছ শিকার বন্ধ করা হয়, তা তিনি বুঝতে পারেন না। জাহাঙ্গীরের দাবি, মৌসুমের বিশাল একটা সময় মাছ ধরতে না পারা এবং আগের মতো মাছ না পাওয়ায় গত চার বছরে প্রায় ৬ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে তার। তাই বাধ্য হচ্ছেন পেশা পরিবর্তন করতে।

একই এলাকার আরেক জেলে জামাল আকন (৫২)। প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় ছিলেন। কিন্তু শেষে এক লাখ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দুবাই চলে যান ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়।

দাদার হাত ধরে পেশায় এসেছিলেন মো. সোহেল (২৯)। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এখন পেশা ছাড়তে মারিয়া। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রে যে মাছ পাই তার শতকরা ১০ ভাগ আড়তদার কমিশন হিসেবে নিয়ে নেয়। তাদের টাকা না দিয়ে কোনো উপায় নেই। গভীর সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝায় নৌকা ও জাল প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো মেরামতের জন্য সময়-অসময়ে নগদ টাকার দারকার হয়। কোনো কোনো সময় মাছ ধরা না পড়ায় দিনের দিনের পর শূন্য হাতে সাগর থেকে ফিরতে হয়। তখন বাধ্য হয়ে মহাজনের কাছ থেকে দানন নিতে হয়। মৌসুমে যদি মাছ মোটামুটি পড়ে, তা দিয়ে যা ইনকাম হয় কোনো মতে দিন চলে। বছরের পর বছর যায় কিন্তু দাদনের ঋণ আর শোধ করতে পারেন না সোহেল। তার দাবি, এখন সমুদ্রে মাছ না পড়ার কারণে তাদের মতো হাজার হাজার জেলে পেশা পরিবর্তন করে অন্য কাজের দিকে ঝুঁকছে।

কেন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না : জাহাঙ্গীর (৪৩), জামাল আকন (৫২) ও সোহেলসহ (২৯) একাধিক জেলে জানান, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে চর বিজয় নামক বিশাল এক চরের। স্থানীয়দের কাছে যা হাইরার চর নামে পরিচিত। হাজার হাজার একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ চর শীতকালে অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। চলতি বছর স্থানীয় সংসদ সদস্য মহিবুর রহমানকে নিয়ে এ চরে বৃক্ষরোপণ শুরু করেছে স্থানীয় বন বিভাগ। পূর্ব-পশ্চিমে ১০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এ চরের কারণে রামনাবাদসহ প্রায় ১০টি নদীর মোহনায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর মূল চ্যানেল ভরে গিয়ে ছোট ছোট বিকল্প চ্যানেল দিয়ে পানি ওঠানামা করছে। জোয়ারের সময় চরগুলো দেখা না গেলেও ভাটার সময় চরগুলো জেগে ওঠে। জেলেরা জানান, উপকূলজুড়ে অসংখ্য ছোটবড় চর জেগে ওঠায় মাছ চলাচলের গতিপথ নষ্ট হয়ে গেছে। যে কারণে আগে যে সব জায়গায় জাল পাতলে মাছ পাওয়া যেত, এখন সেসব স্থানে কোনো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তারা আরও জানান, পায়রা বন্দরের জাহাজ আসা যাওয়ার জন্য রামবনাবাদ চ্যানেলের মোহনা থেকে এক নম্বর বয়া পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার চ্যানেল ড্রেজিং করে নাব্য সংকট কাটানোর কাজ চলছে। সাগরের মাঝে প্রতিনিয়ত ড্রেজিং চলমান থাকায় এবং সাগর থেকে বালি তুলে আবার সাগরে ফেলায় মাছের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি তাদের। তারা আরও বলেন, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গরম পানি সরাসরি নদীতে ফেলায় রাবনাবাদ চ্যানেল অচিরেই মাছশূন্য হয়ে পড়তে পারে।

এ বিষয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাজেদুল হক জানান, জেলেরা যে দাবিগুলো করেছে এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা গবেষণা নেই। গত কয়েক মাস আগে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একজন চায়নিজ প্রকৌশলী তাদের ক্যাম্পাসে গিয়ে রাবনাবাদ চ্যানেলে পানির কতগুলো নমুনা পরীক্ষা করিয়েছেন। বড় ধরনের কোনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র লবণপানির কোনো ঝুঁকিতে পড়বে কিনা সেটা ছিল পানি পরীক্ষার মূল কারণ। তিনি জানান, উপকূলের জেলেরা সাগরে মাছ না পেলেও ট্রলিং এ যারা মাছ শিকার করছেন, তারা কিন্তু মাছ পাচ্ছেন। এখন জেলেরা যে দাবিগুলো করছে এ বিষয়ে দ্রুত একটি গবেষণা করা প্রয়োজন। আসলেই পায়রা তাপবিদ্যুতের কারণে কোনো প্রভাব পড়ছে কিনা সেটা জানা দরকার। আর সমুদ্রে যে ছোট বড় চর জেগে উঠেছে, তার ফলে কী পরিমাণ মাছের প্রজননক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে তাও জানা প্রয়োজন। এই গবেষক দাবি করেন, আগের তুলনায় জেলে এবং ট্রলারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রত্যেকের ভাগ থেকে মাছ কমে যাচ্ছে। কিন্তু সামষ্টিকভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সনাতনী পদ্ধতিতে মাছ শিকার করায় মাছ কম পাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।

সার্বিক বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, কুয়াকাটা সমুদ্রসংলগ্ন এলাকা থেকে গত কয়েক বছর ধরে ইলিশ মাইগ্রেট করে কক্সবাজার এবং ভোলা জেলাসংলগ্ন চর কুকরি-মুকরি, পটুয়াখালীর সোনার চরের মোহনাগুলো দিয়ে পদ্মা-মেঘনায় যাতায়াত করছে। এ কারণে কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে মাছের পরিমাণ কম। তা ছাড়া এই এলাকা থেকে মাছ অন্য এলাকা দিয়ে যাতায়াত করার ফলে পায়রা এবং রাবনাবাদ চ্যানেলে ইলিশের সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে যেহেতু ইলিশ এখান থেকে মাইগ্রেট করা শুরু করেছে, ভবিষ্যতে অন্য সব মাছও এই নদীগুলো থেকে মাইগ্রেট করে অন্যত্র চলে যাবে। জেলেরা পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দায়ী করছেন। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এলাকার পলিথিন এবং বর্জ্য সাগরে ফেলাকে দায়ী করছেন। হঠাৎ করে মাছ কেন গতিপথ পরিবর্তন করছে? জবাবে তিনি বলেন, এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। তবে স্বাভাবিক দৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সমুদ্র মোহনাগুলোতে চর পড়ে যাচ্ছে। চর বিজয়ের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন দৃশ্যমান। এটি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের বুকে চর জেগে ওঠার ফলে মাছের গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, এক এলাকায় মাছ না পাওয়া গেলেও অন্য এলাকায় কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে। বছর শেষে দেখা যায় ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাছ না পাওয়ায় কি পরিমাণ মানুষ পেশা পরিবর্তন করছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এ বিষয়টি নিয়ে মাঠপর্যায়ে একটি জরিপ কাজ চলামান রয়েছে। শতকরা কতভাগ লোক পেশা পরিবর্তন করছে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব হবে বলে দাবি করেন তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here