হাওর- কারও শখ কারও সর্বনাশ ‘বড় দেরিতে তুমি বুঝলে…’

0
80

হাওরের ফসল নিয়ে মানুষের শঙ্কা আশঙ্কা যখন তুঙ্গে। হা-হুতাশে হাবুডুবু খেতে খেতে গলা পানিতে নেমে যখন দিনরাত বাঁধ রক্ষার কাজ করছে সাধারণ কৃষক। চোখের জল ফেলতে ফেলতে কাঁচা ধান কাটছে তখন ঘোষণা এলো শখের সড়ক আর হবে না হাওরে। দরকারে হবে উড়ালসড়ক। সোমবার (১৮ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন। সে সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খুব খোলাসা করেই বলেন, ‘আজ ক্লিয়ার ইন্সট্রাকশন দেওয়া হয়েছে যে, হাওর এলাকায় কোনো রাস্তাঘাট এখন থেকে আর করা যাবে না। যদি কিছু করতেই হয় সেটা এলিভেটেড (উড়াল) করতে হবে, যাতে করে পানি চলাচলে বাধা না আসে।’ অনেক শখ-আহ্লাদের আবুরা সড়কের বিরূপ প্রভাব নিয়ে যে নীতিনির্ধারক মহল অস্বস্তিতে আছেন সেটা এখন ঢাকার যানজটে বসেও অনুভব করা যায়। সচিব শুধু ভবিষ্যতের উড়াল রাস্তার সিদ্ধান্ত জানাননি, তিনি বর্তমান রাস্তার সংস্কারের কথাও বলেছেন। জানিয়েছেন পানিপ্রবাহের সুবিধার্থে বিদ্যমান রাস্তাগুলোতে আরও ব্রিজ নির্মাণ করা যায় কিনা সে বিষয়ে সার্ভে করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রোডস অ্যান্ড হাইওয়েকে বলা হয়েছে, প্রতি আধাকিলোমিটার পরপর দেড়শ থেকে দু’শ মিটার ব্রিজ করে দেওয়া যায় কিনা তা সমীক্ষা করার জন্য।

হাওরে এবার পানি নামতে সময় লেগেছে অনেক ফলে শুকনা মাটি সময়মতো মেলেনি বাঁধ বাঁধার জন্য। মাটিতে জো আসতে আসতে ধান লাগানোর সময় পার হয়ে যায় যায় অবস্থায় হয়েছিল নাবি জমিতে। হাওরের মূলত দুটি অংশ। একটি মূল জলাশয়, যার পানি বছরের সব সময় থাকে। টাঙ্গুয়ার হাওরে বা হাকালুকি হাওরে শুষ্ক মৌসুমে (শীতকালে) এ জলাশয় দেখা যায়। দ্বিতীয় অংশটি হলো ছয় মাস পানির নিচে থাকে, অর্থাৎ বছরের ছয় মাস শুকনো থাকে। মূলত এ জমিগুলো কৃষিজমি। বছরের ছয় মাস এখানে ধান, পাটসহ বিভিন্ন কৃষি ফসল উৎপাদন করেন কৃষকরা। বৃষ্টিপাতের মৌসুমের তারতম্য হলে বা পানি নামতে উনিশ-বিশ হলে এ কৃষি বিপন্ন হয়, বড় ঝুঁকিতে চলে যায় মানুষের জীবন জীবিকা।

হাওরে পাকা সড়কের কথা শুনে তাই পরিবেশ আর হাওর বাস্তুতন্ত্রের গবেষকরা এই সর্বনাশা শখের ঘোড়া দাবড়াতে না করেছিলেন। কেউ শোনেনি জিদ বড় বালাই। জিদের অল ওয়েদার সড়কের (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের মধ্যে প্রায় ২৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার) কারণে হাওরে পানি আগের মতো গতিতে আর সাগরে যাচ্ছে না। জমে থাকছে। সড়কের কাজ শুরু হতেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন হিসাব করে বলেছিলেন, এ রকম এক সরু পথে এক বছরের পানি প্রবাহিত হতে অনেক বছর লেগে যাবে। তার কথা অনুযায়ী, প্রতিবছর সব পানি বের হয়ে যাবে না এবং প্রতিবছর পানি জমতে থাকবে। এক সময় হাওরের সব কৃষিজমি পানির নিচে চলে যাবে এবং স্থায়ীভাবে পুরোটা জলাভূমিতে পরিণত হবে। হাওরের ধান তথা কৃষি বন্ধ হয়ে যাবে। হাওরের শস্যভা-ারের তকমা মুছে যাবে। তিনি আরও বলেছিলেন, যখন প্রতিটি জনপদ এ রকম সড়ক দিয়ে সংযুক্ত করা হবে, তখন হাওর খ–বিখ- আবদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হবে, যার পানি কখনো নেমে যাবে না। বরং প্রতিবছর বেড়ে গিয়ে মারাত্মক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। সৃষ্টি হবে মানবিক বিপর্যয়। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক খান এম আমানত একটি জনপ্রিয় দৈনিককে বলেছিলেন, ‘হাওরে যেভাবে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব আছে। চলনবিল দিয়ে সড়ক নির্মাণের ফলেও একই প্রভাব পড়েছে।’

এসব সাবধান বাণী ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সড়কের প্রবক্তারা বলেছিলেন, ‘একটি মহল ভয় দেখিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়, এসব ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। মানুষ ভয় পায় না। মানুষ উন্নয়নে পেয়ে গেছে। এখন উন্নয়নে কেউ বাধা দিলে তাদের প্রতিহত করা হবে।’

মানুষ এখন দেখছে কোনটা সত্যি, কোনটা সত্যি নয়। সময়মতো নামতে না পাড়া পানির সঙ্গে আসা বালু ফেলে দিচ্ছে জমিতে। অষ্টগ্রামে বালুময় পতিত জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার খবর ইতোমধ্যেই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ৮৭৪ কোটি টাকা খরচ করে কথিত ‘দৃষ্টিনন্দন’ অল ওয়েদার সড়ক ক্রমেই স্বাভাবিক পানিপ্রবাহকে বিঘিœত করছে। সড়ক নির্মাণের আগে যেখানে বর্ষা মৌসুমে এই ২৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার জায়গা দিয়ে পানি মুক্তভাবে প্রবাহিত হতো। এখন সড়ক করার পর তিনটি বড় সেতুসহ ১৪টি ছোট-বড় কালভার্ট ও আরসিসি পুল দিয়ে পানি বেরোতে পারছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ১ কিলোমিটারের কম। মানে পানির সনাতন ২৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের রাস্তা এখন কমে মাত্র ৮০০ মিটার।

সড়কের প্রতিবন্ধকতায় পানি নামতে দেরি হলে ভেস্তে যাবে কম সময়ের ধান উদ্ভাবনের গবেষণা। ধান গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা আগাম বর্ষার আগেই ধান কাটার উপযোগী করে তোলার জন্য যে নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন তা আর কোনো কাজে আসবে কি? হাওরের কৃষকদের প্রয়োজন স্বল্প জীবনকালসম্পন্ন (১২০-১৪০ দিন), ঠা-াসহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল ধান, যার ফসল আগাম বন্যার আগেই ঘরে তোলা যায়। হাওরাঞ্চলের জন্য স্বল্প জীবনকালসম্পন্ন, ঠা-াসহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ব্রি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও নেপাল থেকে ঠা-াসহিষ্ণু জাতের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করেছে। চলমান গবেষণা ইতোমধ্যেই নতুন এক জাতের সন্ধান দিতে পেরেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে উদ্ভাবিত জাতটির নাম দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু ধান ১০০। হবিগঞ্জের নাগুড়ায় ব্রির জমিতে এই ধানের চারা উদ্ভাবন করা হয়েছে। ‘পরীক্ষণ প্লট’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কিশোরগঞ্জের নিকলি হাওর, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা বাকাটিয়ার হাওর, বানিয়াচং উপজেলার মকার হাওর, নবীগঞ্জ উপজেলার গুঙ্গিয়াজুরী হাওর, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর হাওর, শনির হাওর ও মাটিয়ান হাওর।’ এটি ব্রি-২৮ ধানের মতো দেড়শ দিনে ফসল কাটার উপযোগী হবে। অক্টোবরেই এর বীজতলা তৈরি করা যাবে। শীতে কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু পানি নামতে দেরি হলে এই উদ্ভাবন-গবেষণা হাওরের উপকারে লাগবে কি?

হওরে পাকা সড়ক নির্মাণ বন্ধের সিদ্ধান্ত আরেকবার শুনানো হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে (২১ নভেম্বর)। সেদিন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) ‘হাওর এলাকায় উড়ালসড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ অনুমোদনের পর বলা হয়েছিল আর সড়ক নয়। তখন এটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

সেই পরিকল্পনায় হাওর জেলা সুনামগঞ্জের সঙ্গে নেত্রকোনা জেলার আধুনিক যোগাযোগ স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল দুই জেলার পাঁচটি উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন হলে হাওরের কৃষিপণ্য ও মৎস্যসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দ্রুততম সময়ে ও সহজে পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত হবে। পর্যটকের মেলা বসবে হাওরে। পর্যটনের প্রসার হলে হাওরবাসীর জীবনমানের উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। ২০২৬ সালের জুন মাসে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা।

উড়ালসড়ক নিয়েও কথা আছে

প্রকৃতিতে কৃত্রিম কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে তার প্রভাব পড়বেই। এমনিতেই হাওরের জলজ ও প্রাণী হুমকির সম্মুখীন। অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে সেটি যেন আরও ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপন্ন না হয়ে পড়ে, সেজন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন এবং প্রকল্প গ্রহণের আগে আরও যাচাই-বাছাই করে দেখা প্রয়োজন।

পাকা সড়কের চেয়ে উড়ালসড়কে ক্ষতি কিছুটা কম হলেও সব ক্ষতি এড়ানো যাবে না। পিলার নির্মাণের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। এতে মাছের চলাচলও বিঘিœত হবে। যেমন হাওরের চিংড়ি মাছ কম স্রােতের পানিতে চলাচল করে, প্রতিবছর একটি অঞ্চলে ডিম দিয়ে বংশবৃদ্ধি করে। চিংড়ির বংশবৃদ্ধি করা রাস্তায় বা জায়গায় সড়ক হলে বা পিলার অথবা সড়ক বাঁধের মতো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তাদের বংশবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত হবে। অন্যান্য জলজ প্রাণীরা বংশবৃদ্ধি না করতে পারলে বিলুপ্ত হতে শুরু করবে; নষ্ট হবে হাওরের জীববৈচিত্র্য। পর্যায়ক্রমে একটির পর একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে শুরু করবে। ফলে এক সময় হাওর হবে মাছহীন জলাভূমি।

তা ছাড়া যেমন বলা হচ্ছে, উড়ালসড়ক নির্মাণ হলে দুই পাশের পর্যটন এলাকাকে ঘিরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে থাকার জন্য নির্মিত হবে অনেক হোটেল-মোটেল। হাওরের বুকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য তৈরি হবে নানা আকৃতি ও প্রকৃতির রঙবেরঙের নৌকা, স্পিডবোটসহ নানা ধরনের আকর্ষণীয় জলযান। এতে তেল দূষণের সঙ্গে সঙ্গে বায়ু ও শব্দদূষণের কবলে পড়বে হাওরের প্রকৃতি।

ভুললে চলবে না, আমাদের মতো হাওর পৃথিবীতে আর নেই। ফলে যারা হাওর দেখেনি ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে তার রূপের পরিবর্তন লক্ষ করেনি তাদের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে তেমন কাজ করবে না। সবচেয়ে ভালো হয়, হাওর এলাকার মানুষের মতামত এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যবেক্ষণকে আমলে নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করলে। শুধু শখ পূরণের জন্য, পর্যটক আকর্ষণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হলে হাওরের ক্ষতিই বাড়বে। ‘জেগে জেগে খুলে চোখ বুজলে ঘুমটা ভাঙানো তো যাবে না।’ হাওরটাও বাঁচবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here