হাহাকারের মধ্যেই দাম বাড়ছে সয়াবিনের

0
90

সয়াবিন তেলের অভাবে ঈদের রান্নাটা এবার ঠিকঠাক করতে পারেননি রাজধানীর কদমতলীর তুষারধারা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা নাজমা সিদ্দিক। ঈদের আগে এলাকার সব দোকান ঘুরে দুলিটারের একটি বোতল জোগাড় করতে সক্ষম হন তিনি। এ জন্য তাকে গুনতে হয় ৩৮০ টাকা। ঈদ উদযাপন শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার সয়াবিনের খোঁজে বাজারে এসে আবারও বিপাকে পড়তে হয় এ গৃহিণীকে। কারণ বাজারে সয়াবিনের সংকট এখন মহাসংকটে রূপ নিয়েছে। বাড়তি টাকায়ও মিলছে না সয়াবিনের বোতল। সংকট দেখা দিয়েছে খোলা তেলের বাজারেও। এরই মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় নতুন করে তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ ভোজ্যতেলের হাহাকারের মধ্যেই আগামী শনিবার থেকে প্রতি লিটার বোতলজাত তেল কিনতে হবে ১৯৮ টাকায়। গতকাল তুষারধারা বাজারে গৃহিণী নাজমা সিদ্দিক আমাদের সময়কে বলেন, ‘দুই লিটারের এক বোতল দিয়ে ঈদটা কোনো রকমে পার করেছি।

বাসায় এখন এক বেলা রান্নার তেলও নেই। বাজারে এসে দেখি আগের থেকেও খারাপ অবস্থা। এর আগে বাড়তি টাকা দিয়ে কিনতে পারলেও এখন সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। দোকানিরা সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, তেল নাই। খোলা তেলও মিলছে না। কয়েকটি দোকানে পেলাম, দাম চাইছে ২০৮ টাকা কেজি।’

নাজমা সিদ্দিকের মতো পকেটে বাড়তি টাকা নিয়েও বাজারে সয়াবিন তেলের বোতল পাচ্ছেন না আরও অনেক ক্রেতা। রাজধানীর কারওয়ানবাজারেও একই দুর্ভোগের শিকার বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সিরাজুল ইসলাম। দীর্ঘক্ষণ ঘোরাঘুরির পর পাঁচ লিটারের এক বোতল তেল ৯০০ টাকায় কিনতে হয় এ ভদ্রলোককে। কথা হলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আমাদের জিম্মি করে অনৈতিকভাবে ইচ্ছামতো ব্যবসা করে নিচ্ছে। বোতলে লেখা ৭৬০ টাকা, অথচ কিনতে হলো ৯০০ টাকায়।’

কারওয়ানবাজার ‘কিচেন মার্কেটের’ ঢাকা জেনারেল স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মুজাহিদ বলেন, ‘এ বাজারে যা একটু তেল পাওয়া যেত, ঈদের আগে মোবাইলকোর্টের অভিযানের পর কেউ আর দোকানে তেল রাখছেন না। কারণ আমাদেরই তেল কিনতে হচ্ছে বোতলের গায়ে লেখা এমআরপি রেটে। লাভ রেখে তা বিক্রি করতে গেলে বেশি দাম রাখার অভিযোগে মোবাইলকোর্ট জরিমানা করছে। তার ওপর সয়াবিনের সঙ্গে চিনিসহ কোম্পানির বিভিন্ন পণ্য কিনতে বাধ্য করছেন ডিলাররা। এত ঝামেলা করে কে তেলের ব্যবসা করবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রেতা জানান, বেশি লাভের জন্য অনেক ব্যবসায়ী বোতল ভেঙে খোলা হিসেবে তেল বিক্রি করছেন। কারণ এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের বর্তমান নির্ধারিত মূল্য ১৬০ টাকা। অথচ খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ২০২ থেকে ২০৬ টাকা পর্যন্ত।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই তেলের বাজারে কারসাজি চলছে। বাজার তদারকি চালিয়ে দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। বাজারে সয়াবিনের সংকট রয়েছে কিনা এ বিষয়ে আগামী রবিবার থেকে আমরা আবার তেলের বাজার তদারকি শুরু করব।’

এবার রোজার শুরু থেকেই বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দেয়। তেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে জানালেও খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ- চাহিদা অনুযায়ী তেল পাচ্ছেন না তারা। বাজারে পাঁচ লিটারের বোতল নেই বললেই চলে। এরই মধ্যে সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার সরকার সয়াবিন তেলের কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে আরও অস্থির হয়ে ওঠে বাজার। ঈদের আগে লাফিয়ে বাড়ে খোলা তেলের দামও। বাজারে এখন খোলা তেলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০৬ থেকে ২০৮ টাকা পর্যন্ত। পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা পর্যন্ত। এরই মধ্যে গতকাল তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন’।

জানা গেছে, গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে মিল মালিকদের বৈঠকের পর বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী শনিবার থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে। সর্বশেষ নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী বর্তমানে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৬০ টাকা। যদিও সংকট তীব্র হওয়ায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে অতিরিক্ত দামে।

গতকাল বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এখন থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হবে ১৯৮ টাকা। অপরদিকে ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা। আগের নির্ধারিত মূল্যে যা ছিল ৭৬০ টাকা। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা এবং খোলা পাম তেল প্রতি লিটার ১৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৩৬ টাকা ও পাম তেলের দাম ১৩০ টাকা।

ভোজ্যতেলের অন্যতম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা আমাদের সময়কে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও অপরিশোধিত পাম তেলের দামে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রয়েছে। তার ওপর ইন্দোনেশিয়া সয়াবিনের কাঁচামাল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ায় বাজার অনেক চড়া এখন। আমদানি খরচ অনেক বেড়েছে। কেউ তো আর লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবে না। এতদিন রমজান উপলক্ষে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়নি। আজ (বৃহস্পতিবার) সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসে সয়াবিনের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে আমাদের।’

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সরকার ও ব্যবসায়ীরা বরাবরই দাবি করে আসছেন যে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। অথচ বাজারে তেল উধাও। এর মানে দাঁড়ায়, ব্যবসায়ীদের কেউ না কেউ বাড়তি লাভের আশায় তেল মজুদ করছেন। আগে থেকেই তারা জানতেন ঈদের পর দাম বাড়বে। এখন দাম বাড়ানোর ফলে সেসব ব্যবসায়ীর বেশ ভালো মুনাফা হবে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভেই তেল নিয়ে কারসাজি হয়েছে এটা পরিষ্কার। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণির ভোক্তারা। তাদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে কারসাজির পর সয়াবিনের দাম বাড়িয়ে সিন্ডিকেটকারীদের শাস্তির বদলে পুরস্কৃত করা হয়েছে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মাসুদ রানা আমাদের সময়কে বলেন, ‘কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি মুনাফা অর্জনে ব্যবসায়ীদের যে অপচেষ্টা ছিল, তা সফল হয়েছে। সরকার সয়াবিনে যে শুল্ক প্রত্যাহার করল, জনগণ তার সুফল তো পেলই না, বরং রোজায় তেলের সন্ধানে বাজারে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে আমাদের। যারা তেল বিক্রি না করে অনৈতিকভাবে মজুদ করেছেন, তারা এখন বিশাল অঙ্কের মুনাফা করবেন।’

যাত্রাবাড়ী এলাকার দিনমজুর মো. জুলহাস বলেন, ‘তেলের এখন যে দাম তাই কিনে খাওয়া সামর্থ্য আমাগো নাই। দাম আরও বাড়াইলে কই যামু আমরা।’

এর আগে রমজানে সয়াবিনের বাজার সামাল দিতে শুল্ক ও ভ্যাট কমানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় সরকার। পণ্যটিতে তিন পর্যায়ে ৩০ শতাংশ ভ্যাট মওকুফের সুবিধা দেওয়া হয়, যা ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে। এ সিদ্ধান্তের পর সয়াবিনের দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণেও এসেছিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here