রোগীর থেকে টাকা নিতে পারবেন না চিকিৎসক

0
76

চিকিৎসক হবেন পূর্বনির্ধারিত বেতনভুক্ত কর্মচারী। তারা কোনোভাবেই রোগীদের কাছ থেকে নিজে টাকা নিতে পারবেন না। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদান এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের প্রয়োজনীয়তা আছে। তাই প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করতে হলে চিকিৎসকদের কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের (হাসপাতাল/ক্লিনিক) সঙ্গে মাসিকভিত্তিতে নির্দিষ্ট বেতনে চাকরিজীবী হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারবিষয়ক প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. বিলকিস বেগম স্বাক্ষরিত ‘স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারবিষয়ক প্রতিবেদনে বর্ণিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে’ শীর্ষক চিঠিতে উল্লেখ করা হয় এসব বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসের নেতৃত্বে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ‘স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারবিষয়ক’ মতবিনিময় সভায় এসব সুপারিশ করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এককভাবে বা দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একটি কোম্পানি/হাসপাতাল/ক্লিনিক হিসেবে সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন। সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে ক্যাশ রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী অর্থ সংগ্রহ করা হবে। কোনোভাবেই কোনো চিকিৎসক সরাসরি রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারবেন না। তবে হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা প্রতিষ্ঠানের মোট রোগীর সংখ্যার ওপর চিকিৎসকের মাসিক আয় সম্পর্কযুক্ত হবে না। চিকিৎসক হবেন পূর্বনির্ধারিত বেতনভুক্ত কর্মচারী। কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজে ব্যবসায়ী এবং চিকিৎসক হতে পারেন না। চিকিৎসকের সব আয় ব্যক্তির ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শিত হতে হবে।

সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের ব্যবস্থা একই হাসপাতালে/প্রতিষ্ঠানে সরকার নির্ধারিত মূল্যে করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতে সরকারি চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করতে পারেন না। সে জন্য তারা সরকার নির্ধারিত হারে (১৫ থেকে ২০ শতাংশ) ভাতা পেয়ে থাকেন। চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত সবাই সবসময় সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও নির্ধারিত সময় ছাড়া সাধারণ কর্মসময় দৈনিক ১২ ঘণ্টার বেশি হওয়া উচিত নয়।

মেডিক্যাল পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবীদের (ডাক্তার, নার্স, টেকনোলজিস্ট) নৈতিকতা রক্ষার্থে, দেশে মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, অবিলম্বে ওষুধ শিল্প ও মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট সরবরাহকারীদের সুস্পষ্ট বিপণন পদ্ধতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে সুপারিশে। এক্ষেত্রে সরাসরি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির প্রচারের ব্যবস্থা বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কোম্পানিগুলোকে বার্ষিক উৎপাদন, বিপণন এবং অন্যান্য ব্যয় জনসম্মুখে প্রকাশে বাধ্য করার বিধান রাখতেও। সুপারিশে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের আইন রয়েছে। সেখানে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করে থাকে।

এদিকে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার নিয়ে এই প্রতিবেদন বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন পেশাজীবী চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এসব প্রস্তাবনা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবসম্মত নয়। কারণ দেশে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগীরা প্রয়োজনীয় সেবা পান না। সব রোগীর পক্ষে বেসরকারি ব্যয়বহুল সেবা গ্রহণ সম্ভব হয় না। সুস্থতার জন্য তারা প্র্যাক্টিসিং চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হন। তা ছাড়া একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ব্যক্তিগত সময়ে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করেন। এ ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে অনেক চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাক্টিস বন্ধ করে দেবেন। তারা ওষুধ কোম্পানি, দাতা বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সি করবেন। এতে বিপুল সংখ্যক রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঝুঁকিতে পড়বে।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, ‘এই সুপারিশে যা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো যুক্তিসঙ্গত নয়। এটা আমলাদের ষড়যন্ত্র। চিকিৎসকদের খেপিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলতে এ ধরনের সুপারিশ করা হতে পারে। কোভিডকালীন সময়ে চিকিৎসকদের কর্মকাণ্ড প্রশংসার দাবি রাখে। সেক্ষেত্রে আমলারা চিকিৎসকদের নানাভাবে হেনস্তা করতে চেষ্টা করছে। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতনের পেছনেও আমলারা চিকিৎসকদের এভাবে খেপিয়ে তুলেছিল। তাই এই সুপারিশের বিয়ষটি কর্তৃপক্ষের ক্ষতিয়ে দেখা উচিত। চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাক্টিস সব দেশেই রয়েছে। তাদের নন প্র্যাক্টিসিং করাতে হলে অবশ্যই সরকারিভাবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন দরকার। যেখানে চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।’

চিকিৎসক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এ ধরনের নীতিমালা করা অসম্ভব উল্লেখ করে ডা. আজিজ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ডেল্টাপ্ল্যান বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে হবে। আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং দেশের মানুষের সেবা নিশ্চিতে অবশ্যই স্বাস্থ্যব্যবস্থার আধুনিকায়ন দরকার। তবে সেটি হতে হবে বাস্তববভিত্তিক পদ্ধতিতে।

একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, এই প্রস্তাবনায় অনেক ত্রুটি রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএমএর পক্ষ থেকে ত্রুটিগুলো উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here