সাকার ফিশে ভয়ঙ্কর রাসায়নিক

0
75

অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছ সাকার মাউথ ক্যাটফিশ, যা সাকার ফিশ হিসেবেও পরিচিত। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিক ধাতু ক্যাডমিয়াম; যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি এ মাছ এতটাই বিষাক্ত যে, এটিকে অন্যান্য মাছের খাদ্য কিংবা পোল্ট্রি ফিড তৈরিতেও কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। আশঙ্কার বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাকুয়ারিয়ামের গণ্ডি পেরিয়ে এই বিষাক্ত মাছ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন নদ-নদীসহ উন্মুক্ত জলাশয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাশয়ে দেশি মাছের প্রাকৃতিক খাবার শ্যাওলা ও প্লাংকটন জাতীয় খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকে সাকার। ফলে এটি জলাশয়ে বেশি থাকলে প্রাকৃতিক খাদ্য দ্রুত কমে যাবে। এতে দেশি মাছের উৎপাদন ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য তারা দেশের পুকুর কিংবা যে কোনো জলাশয় থেকে সাকার ফিশ নিধনের সুপারিশ করেছেন।

দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে সাকার ফিশ গত কয়েক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা নদীতে মাছটি জেলেদের জালে আটকা পড়ছে। অনেকে এ মাছ নির্দ্বিধায় খাচ্ছেও বলে জানা গেছে। স্থানীয়রা মাছটিকে ভিন্ন ভিন্ন নামেও চেনেন। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় বদ্ধ জলাশয়, পুকুর, ডোবা, খাল, বিলে এমনকি সব সময় পানি থাকে এমন নর্দমায়ও সাকার ফিশের দেখা মিলছে। চাঁদপুর পুরানবাজার মেঘনা নদীসংলগ্ন হরিসভা এলাকায় গত ১ মে আলাপ হয় স্থানীয় জেলে রাজিব দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, জেলা শহর রক্ষা বাঁধের সঙ্গে যে ব্লক ফেলা হয়েছে, তার গায়ে লেগে থাকে এই সাকার ফিশ। তবে তার ভাষায় এটি ‘আইড়বাইলা’ মাছ। এই নাম কীভাবে জানতে পেরেছেন প্রশ্নের জবাবে রাজিব জানান, মাছের শরীরে আইড় মাছের মতো কালো ছোপ ছোপ দাগ আর শক্ত কাঁটা আছে। অনেকটা আবার বাইলা মাছের মতোই দেখা যায়। বাইলা মাছ মাটির সঙ্গে থাকে, এটিও পানির নিচে পাথর বা মাটির সঙ্গে লেগে থাকে। তাই স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছেন আইড়বাইলা। প্রতিদিন কয়টি মাছ জালে ধরা পড়ে প্রশ্নে তিনি জানান, মাঝে মধ্যে অনেকগুলো পাওয়া যায়। এগুলো বিক্রি হয় এবং কম ধরা পড়লে নিজেও রান্না করে খান তিনি।

জানা গেছে, সাকার মাউথ ক্যাটফিশ আশির দশকে দক্ষিণ আমেরিকা (ব্রাজিল) থেকে অ্যাকুয়ারিয়াম মাছ হিসেবে বাংলাদেশে প্রথম নিয়ে আসা হয়। মাছটি অ্যাকুয়ারিয়ামে সৃষ্ট শ্যাওলা পরিষ্কার করে বলে এর বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু এ মাছটি বর্তমানে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের জলাশয়েও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। এরা পুকুর, কম স্রোতযুক্ত অগভীর নদী, খাল ও বিলের তলদেশে বসবাস করে। এরা ঘোলা, দূষিত ও কম অক্সিজেনযুক্ত পানিতে বাঁচতে পারে।

এ মাছের জীবনযাত্রা এবং পুষ্টিগুণ নিয়ে গবেষণা করেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা। তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাকার ফিশের শরীরে ভারী ধাতু কপার, জিংক, লেড, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে। এই মাছে প্রাপ্ত ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ ১.৭০ থেকে ১.৮৭ এমজি; যা মানব দেহে সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রার তুলনায় ১০০ গুণ বেশি। অন্যান্য ভারী ধাতু কপার, লেড ও ক্রোমিয়ামের পরিমাণ সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে কম। তবে জিংকের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা ৫০.০০ এমজির চেয়ে অনেক বেশি (৫৯.৭১ থেকে ৬৩.৬৭ এমজি) পাওয়া গেছে এ মাছে।

সাকার ফিশের গবেষণা প্রসঙ্গে বিএফআরআইর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘এ মাছ নিয়ে আরও বড় পরিসরে গবেষণা হওয়া দরকার। কয়েকটি উৎস থেকে মাছ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। এতে স্বাস্থ্যর ক্ষতিকর উপাদান ক্যাডমিয়াম ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মাছটি শিকারি মাছ নয়। এরা চুষে খাবার সংগ্রহ করে খায়। হুমকি হচ্ছে, অন্যান্য মাছের সঙ্গে খাবার ও স্থান নিয়ে এরা প্রতিযোগিতা করে। মাছটির উৎপাদনের হার বেশি। ফলে জলাশয়ে এদের আধিক্য থাকলে শ্যাওলা/পেরিফাইটন, প্লাঙ্কটন জাতীয় খাবার প্রচুর পরিমাণে খাবে। এটি থাকলে আমাদের জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাদ্য দ্রুত কমে যাবে। যা অন্যান্য মাছের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ জন্য দেশের পুকুর কিংবা যে কোনো জলাশয় থেকে সাকার ফিশ নিধন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, এ মাছ থেকে অন্যান্য মাছের খাদ্য কিংবা পোল্ট্রি ফিড তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এ নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া দরকার। বিএফআরআই ইতোমধ্যে সাকার ফিশের হাত থেকে দেশের মৎস্য সম্পদ রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে।

জানা গেছে, বিএফআরআইর প্রতিবেদনে এ মাছের বিস্তার রোধকল্পে প্রয়োজন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন, স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে পুকুর প্রস্তুতির সময় ভালোভাবে শুকাতে হবে এবং সাকার মাউথ ক্যাটফিশ সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করতে হবে। পুকুরে জাল টানার সময় ধরা পড়া সাকার ফিশ মেরে ফেলতে হবে। দেশে ইঁদুর নিধন অভিযানের মতো সাকার ফিশ নিধন অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থা করা যেতে পারে প্রণোদনার। গণমাধ্যমে (টেলিভিশন, বেতার ও পত্রিকা) এই মাছের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশ আমদানির ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সরকারের অনুমোদন ছাড়া অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশ আমদানি এবং এর প্রজনন ও পোনা উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। সাকার ফিশের দেহে অঞ্চল/ঋতুভেদে হেভি মেটালের উপস্থিতি ও প্রজনন বিষয়ে নিবিড় গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন। বর্ষা মৌসুমে বদ্ধ জলাশয় থেকে নদ-নদীতে যাতে এ মাছ না যেতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম হচ্ছে- বদ্ধ জলাশয়ের ন্যায় অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় (নদ-নদী, খাল, বিল) থেকে সেচে কিংবা জাল মেরে এ মাছ একেবারে অপসারণ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে (অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে) সাকার মাছের প্রজনন রোধের জন্য কৌলিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ট্রিপলয়েড মাছ উৎপাদন অর্থাৎ এদের বন্ধ্যাকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। উৎপাদিত এসব বন্ধ্যা মাছ পরে উন্মুক্ত জলাশয়ে ছেড়ে দিলে জলাশয়ে এরা প্রজননের মাধ্যমে আর বংশ বৃদ্ধি করতে পারবে না। এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে ৫-৬ বছর সময় প্রয়োজন হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here