সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের কম বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে শতকরা ৩৪ জনই পর্নোগ্রাফি দেখছে। একই সঙ্গে যাদের মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা ৭৫ জন কিশোর-কিশোরী এতে আসক্ত। এ আসক্তির কারণে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও অপরাধপ্রবণতা নিয়ে বড় হচ্ছে তারা। অসুস্থ এ বিনোদন দেশকে একটি বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন মনোবিদ, শিশু ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কিশোর-কিশোরীদের পর্নোগ্রাফির ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না?
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সব বিষয়েই কিউরিসিটিটা বেশি থাকে। আর নিষিদ্ধ কোনো বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বেশি। গার্ডিয়ানরা যখন তাদের মানা করে- এটা দেখা যাবে না, তখন তাদের মধ্যে কিউরিসিটিটা আরও বেশি হয়ে যায়- কেন দেখা যাবে না। কী ব্যাপার? ওরা কিন্তু ‘নিষিদ্ধ জিনিসগুলো’ বেশিরভাগই গ্রুপে দেখে। বন্ধুরা শেয়ার করছে, মজা করছে। অর্থাৎ তাদের কাছে এটা বিনোদনের অংশ হয়ে গেছে। এজন্যই ওরা এটা দেখছে। আরেকটি বিষয়, এ বয়সে তাদের ফিজিক্যাল ও হরমোনাল চেঞ্জ আসতে শুরু করে। এ কারণে তারা ভিন্ন কিছু ফিল করেই। অপজিট সেক্সের প্রতি আকর্ষণ ফিল করে। তখন ওদের মধ্যে যে আকর্ষণ তৈরি সেটা তাদের পর্নোগ্রাফি দেখার দিকে নিয়ে যায়।
বেসরকারি সংস্থা ইনসিডিন সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত এক বছর দেশের ১১টি জেলায় একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপে ৬ থেকে ১৭ বছরের ৫ হাজার ৭৪ জন শিশু-কিশোর অংশ নেয়। জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শতকরা ২৬ জন মেয়েশিশু বা কিশোরী জানিয়েছে, তারা আত্মীয়দের সঙ্গে পর্নোগ্রাফি দেখেছে। আর শতকরা ১৪ দশমিক ৪ জন মেয়েশিশু জানিয়েছে, তারা দেখছে অনাত্মীয়দের সঙ্গে। সংস্থাটি বলছে, শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের এভাবে পর্নোগ্রাফি দেখার মাধ্যমে তাদের ওপর যৌন হয়রানির আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। জরিপে দেখা গেছে, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ২৪ দশমিক ১ শতাংশ।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সিরা সবচেয়ে খারাপ সময় পার করে। বয়সটাও খুবই স্পর্শকাতর। এ বয়সিদের মানসিক পরিচর্চা যদি সঠিকভাবে না করা যায় তাহলে তারা বিপথে চলে যেতে পারে। এজন্য ঘরের বাইরে খেলাধুলা করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যেখানে অভিভাবক, শিক্ষক ও সরকারকে সঠিক ভ‚মিকা পালন করতে হবে।
তবে এজন্য পরিবারের একটা ভ‚মিকা পালনের প্রয়োজন থাকলেও কোনো-কোনো পরিবারের অভিভাবক যৌন বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনার পক্ষপাত নন। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও সংসদ সদস্য ডা. আবদুল আজিজ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রাইমারি শেষ করে হাই স্কুল ও ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সময়ে তাদের অনেক শারীরিক পরিবর্তন হয়। এ বয়সে তাদের যদি কন্ট্রোল করা না যায় তাহলে তারা বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ সময়ে খারাপ বা ভালো যেটাতেই তাদের অভ্যস্ত করানো যায়, সেটাই তারা আদর্শ হিসেবে নেয়। আমরা মানুষ তো, চিন্তাচেতনা কোনো না কোনো কাজে ইনভলভ থাকবেই। আমরা যতই তাদের বলি, বেশি টেলিভিশন দেখ না, মোবাইল ব্যবহার করো না, সেটা কাজে আসবে না। যদি তাদের খেলাধুলা, কালচারাল প্রোগ্রামসহ ভালো কাজে সম্পৃক্ত করতে না পারি।’
পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে কিশোর-কিশোরীদের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কিশোররা মারামারি ও ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘কিশোর-কিশোরীরা যখন এ ভিডিওগুলো দেখছে, তখন ওদের মধ্যে যৌনতাকেন্দ্রিক আগ্রহগুলো বাড়ছে। ফলে কিশোররা ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে দলবদ্ধ ধর্ষণেও জড়িয়ে পড়ছে। আবার ধর্ষণের পর হত্যাও করছে, মেয়ে শিক্ষার্থীকে স্কুল বা কলেজে যাওয়ার পথে যৌন হয়রানি করছে। আবার মেয়েকেন্দ্রিক সম্পর্কের কারণে কিশোরদের এক গ্রুপের সঙ্গে আরেক গ্রæপের সংঘর্ষও হচ্ছে। এক্ষেত্রে কিশোরীদের চেয়ে কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি বাড়ছে।
এ বিষয়ে তৌহিদুল হক বলেন, ‘যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে তাদের বিদ্যমান সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধে গড়ে তুলতে পারছি না আমরা। কারণ তারা শুরু থেকেই বিকৃত একটা মনস্তাত্ত্বিক প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে বড় হচ্ছে। বিপরীত লিঙ্গকে সে মূল্যায়ন করছে নিতান্তই যৌনতার উপকরণ হিসেবে। ফলে জেন্ডার ভায়োলেন্স হচ্ছে। ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। পর্নোগ্রাফি দেখে বড় হওয়া নাগরিকদের মধ্যে একটা অসুস্থ, বিশৃঙ্খল এবং মারমুখী আচরণ বিরাজ করে। এদের কারণে রাষ্ট্র বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যদি দ্রæত এটা প্রতিরোধ না করা যায়।’
এ বিষয়ে ডা. আজিজ বলেন, ‘ওরা দীর্ঘ সময় বন্ধুদের সঙ্গে অলস সময় কাটায়। ফলে পর্নোগ্রাফি দেখা, মাদক সেবন ও ধূমপানের মতো কাজগুলো করার সুযোগ পায়। এ থেকে বের করে আনার উপায় হলো তাদের খেলাধুলা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ যুক্ত করতে হবে। সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটা করে মিনি স্টেডিয়াম তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। আমার ব্যক্তিগত মতামত, শুধু উপজেলায় নয়, প্রতিটি গ্রামে একটা করে খেলার মাঠ করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে প্রতিটি গ্রামে প্রতিযোগিতামূলক খেলা হবে। এর মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের ওই অভ্যাস থেকে বের করে আনা সহজ হবে। বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে, সচেতন করতে হবে, তা না হলে পুরো জাতির জন্য একটা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, যা কারও কাছেই কাম্য নয়।’