Home ফিচার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবার অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবার অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র

যেনতেন পিস্তল বা রিভলবার নয়, এবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযানে পাওয়া গেল আমেরিকার তৈরি একটি ‘অ্যাসল্ট রাইফেল’, যা সাধারণত বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। বৃহস্পতিবার রাতে অত্যাধুনিক এই মারণাস্ত্র পাওয়ার পর কক্সবাজারে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া একই রাতে একযোগে বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। এ ঘটনার পর কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়াসহ স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। তবে আরও অভিযান চালানোর পাশাপাশি সতর্ক করা হয়েছে কক্সবাজার সীমান্তে নিয়োজিত বিজিবি, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসব অত্যাধুনিক অস্ত্র-গুলির নেপথ্যে কথিত রোহিঙ্গা নেতা মিয়ানমারের সন্ত্রাসী নবী হোসেনকে দায়ী করা হচ্ছে। নবী হোসেন বর্তমানে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ (আইস) বাংলাদেশে পাচারের সবচেয়ে বড় হোতা হিসেবে চিহ্নিত।

গোপন তথ্যমতে, কক্সবাজার অঞ্চলে দিনদুপুরে ডাকাতি, অপহরণ ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসী গ্রæপগুলো। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হোতা নবী হোসেন। তার রয়েছে কয়েকটি সক্রিয় সন্ত্রাসী গ্রæপ, যাদের হাতে রয়েছে ভারী অস্ত্র-গোলাবারুদ। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে নবী হোসেন বাহিনীর হাতে ৫ শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। এখন তা বেড়ে হয়েছে কয়েকগুণ। এর মধ্যে দেশীয় অস্ত্রগুলো পাহাড়ি এলাকায় নিজস্ব কারখানায় বানানো হয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকেও ভারী অস্ত্র এসেছে নবী হোসেন বাহিনীর হাতে।

এপিবিএনের অভিযানে বিপুল অস্ত্র-গুলি উদ্ধার : এপিবিএন সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এপিবিএন পুলিশের সদস্যরা জানতে পারেন, ১৫ থেকে ২০ জন দুষ্কৃতকারী কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৮ থেকে ক্যাম্প-২০-এর দিকে যাচ্ছে ডাকাতি করতে। এমন সংবাদে অষ্টম এপিবিএনের অধিনায়কের নেতৃত্বে ময়নারঘোনা পুলিশ ক্যাম্পের আওতাধীন এফডিএমএন ক্যাম্প-১৮-এর অভ্যন্তরে অভিযান চালানো হয়। রাত ১১টার দিকে সেখানে ৫ থেকে ৬ জন ব্যক্তিকে ক্যাম্প-২০-এর দিকে যেতে দেখে এপিবিএন তাদের চ্যালেঞ্জ করে। এ সময় তারা অতর্কিত দুই রাউন্ড গুলি ছুড়ে ক্যাম্প-২০-এর দিকে যেতে থাকে। এপিবিএনের দলটি পাল্টা গুলি ছুড়ে পলায়নরত দলটিকে ধাওয়া করলে তারা দ্রুত ক্যাম্প-২০-এর দিকে ঢুকে পালিয়ে যায়। পালানোর সময় একটি ব্যাগ ফেলে যায় সন্ত্রাসীরা। পরবর্তী সময়ে ব্যাগটি তল্লাশি করে একটি অ্যাসল্ট রাইফেল (যুক্তরাষ্ট্র) এবং বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়। এ ঘটনায় পুলিশের কেউ হতাহত হননি।

এ ঘটনার পরপরই ৮ এপিবিএন সব ক্যাম্পে একযোগে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে জামতলি পুলিশ ক্যাম্প-১৫-এর আওতাধীন এফডিএমএন ক্যাম্প-১৫-এর ই/৬ ব্লক থেকে দুইজনকে আটক করে পুলিশ। আটকরা হলো- মোহাম্মদ হোসেন (৩০) ও জাহেদ হোসেন (৩০)। আটকরা উভয়ে রেহিঙ্গা ক্যাম্প-১৫-এর বাসিন্দা। পরে মোহাম্মদ হোসেনের শেডে অভিযান চালিয়ে থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও তিন রাউন্ড তাজা গুলি এবং ৬ হাজার ৩০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

এ প্রসঙ্গে অষ্টম এপিবিএনের অধিনায়ক পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান জানান, অন্য আসামিদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় উখিয়া থানায় নিয়মিত মামলা করা হয়েছে।

অন্যদিকে একই দিন সন্ধ্যায় টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের নুরালীপাড়া সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় ড্রোনের সাহায্যে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করেছে ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)।

১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের নুরালীপাড়া সংলগ্ন পাহাড়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আস্তানার সন্ধানে ড্রোনের সাহায্যে অভিযান চালানো হয়। এ সময় পাহাড়ি এলাকায় গুহার মধ্যে লুকিয়ে রাখা চারটি এলজি ও চার রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাওয়ায় আটক করা যায়নি। ক্যাম্প ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় জেলা পুলিশ এবং এপিবিএনের এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

নেপথ্যের হোতা নবী হোসেন : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, সন্ত্রাসী নবী হোসেন প্রথম আলোচনায় আসেন ২০১৮ সালে। তিনি সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে ‘মাস্টার নবী হোসেন’ বলেও পরিচিত। রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিব্বুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আরাকানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসার বিরুদ্ধে ক্যাম্পে জনমত গড়ে ওঠে। প্রশাসনের পাশাপাশি তাদের প্রতিরোধ করছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। এতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে ক্যাম্পে শক্তি বৃদ্ধি করে নবী হোসেন বাহিনী। রোহিঙ্গা ভাষায় বেশ কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেল চালু করে নানা কার্যক্রম প্রচার করে চক্রটি।

রোহিঙ্গাদের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে নবী হোসেনের অধীনে সহস্রাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য রয়েছে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ করে পর্যায়ক্রমে মিয়ানমারে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এসব সদস্যের প্রত্যেককে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন দেন নবী হোসেন।

এ ছাড়া নিয়মিত মাদক চালানের কমিশনও পায় বাহিনীর সদস্যরা। গুঞ্জন রয়েছে, পাশর্^বর্তী একটি দেশের অস্ত্রের কালোবাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার অত্যাধুনিক ও ভারী অস্ত্র কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ত্রাস নবী হোসেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী হোসাইন কবির সময়ের আলোকে বলেন, নবী হোসেন দেশের জন্য হুমকি। তাকে ধরতে ৩৪ বিজিবির পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরেক ত্রাস মাস্টার মুন্না। সে নবী হোসেন বাহিনীর ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’। দেশে ৫০ ভাগের বেশি মাদক তাদের হাত ধরে ঢুকছে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে পতাকা বৈঠককালে নবী হোসেনের ছবি দেখিয়ে সবকিছু বলা হলে তারা সেখানে কয়েকটি আস্তানা ধ্বংস করেছে। তবে নবী হোসেন নাফ নদের ‘লম্বা লাইন’ নামক এলাকায় আত্মগোপনে থাকেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। তবে সেই এলাকাটি মিয়ানমার সীমানায় হওয়ায় অভিযান চালানো যাচ্ছে না।

অন্যদিকে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পে সব ধরনের অপরাধ হচ্ছে। রোহিঙ্গারা এ দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠলেও এখনও প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো হয়নি। বরং ক্যাম্প এলাকার চেকপোস্ট থেকে সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here