Home ফিচার কমলাপুর রেলস্টেশন: কেমন আছেন ‘লাল জামা’র মানুষরা

কমলাপুর রেলস্টেশন: কেমন আছেন ‘লাল জামা’র মানুষরা

0

দেখিনু সেদিন রেলে/ কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে!/ চোখ ফেটে এলো জল/এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?/ যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে/ বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে …। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত বিদ্রোহী কবি কাজী ইসলামের ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় এ নিপীড়িত শ্রেণির যে জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে আজ প্রায় ১০০ বছর পরেও তার খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতিতে মানুষের বোঝা টানা এ মানুষগুলোর জীবনের চাকা যেন আরও নড়বড়ে হয়ে গেছে। তা আর চলতেই চায় না। দেশে হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়েছে বাজারে। তর তর করে বেড়েছে প্রায় সব পণ্যের দাম।

ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি আয়ের ছিটেফোঁটা। এতে অসহায় হয়ে পড়েছে নিম্ন মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ডের লাল পোশাকে কুলি পরিচয়ে কাজ করা মানুষগুলোর অবস্থা আরও করুণ। একে তো মজুরি কম, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতি। এতে উভয়সঙ্কটে পড়েছেন তারা। রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে কুলির কাজ করা একাধিক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের এ সঙ্কটকালীন দুঃখগাথা।

তখন দুপুর ১টা বেজে ৩০ মিনিট। হুইসেল বাজিয়ে একের পর এক ট্রেন আসছে। ট্রলি হাতে প্ল্যাটফর্মের এপাশ থেকে ওপাশ ছোটাছুটি করছেন আহাদ আলি। কাছে যেতেই বললেন, ‘এহনো দুপুরের ভাতের ট্যাহা নাই। আগে খাওনের ট্যাহা খুঁইজ্যা লই। আগে দিনে সাত-আটশ টাকা ইনকাম হইতো। এখন মানুষজন ডাকেও না। আর আমগো যারা নেয়, মাল টাইনা দেই হেরা মোগো বেশি ট্যাহা দিতে চায় না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমলাপুর রেলস্টেশনে ২১০ জনের মতো মানুষ কুলির কাজ করেন। তাদের কেউ কিশোর, কেউ যুবক, কেউ বয়সের ভারে নুইয়ে পড়লেও ঘাম ঝরিয়ে কাজ করে চলেছেন। কেউ কাজ করছেন বছর দুয়েক, আবার কেউ পার করেছেন দুই যুগ। তাদের সবারই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গল্প। অধিকাংশের গল্পই কষ্টের!

মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সবকিছু হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যান মোহাম্মদ শাকিল (৬৫)। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় কাজের খোঁজে ঘুরে শেষমেশ থিতু হয়েছেন কমলাপুর রেলস্টেশনে। একজনের মাধ্যমে এখানে কুলির কাজ নেন। সেই দিনগুলো এখন ভাসা ভাসা স্মৃতি! জানালেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। তিনি বলেন, ‘সকাল থেইকা দুইডা কাজ পাইছি। একজনে দিছে ৫০ টাকা, আরেকজনে দিছে একশ। এল্লে করমু কি! আমার নাস্তা করতেই লাগছে অর্ধেকের বেশি। সারা দিন চলুম কেমনে…, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সব দখল হয়ে গেছিল। এরপর আব্বা মারা যায়। মা সব গুছাই নিছিল…। তারপর ঘুরতে ঘুরতে চলে আসি কমলাপুর রেলস্টেশনে।’

জীবনের ২৫ বসন্ত এ রেলস্টেশনে পার করেছেন তিনি। নুন আনতে পানতা ফুরায়- এমন অবস্থা হয়েছে বহুবার। তবে এমন দুর্দশা হয়নি কখনও। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরপরই সবকিছুর দাম বাজারে এত পরিমাণে বেড়েছে, বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আক্ষেপ নিয়েই বললেন, বয়স অনেক হয়েছে। এবার হয়তো না খেতে পেয়েই মারা যাব। সংসারে সবার চাহিদাও বাড়ছে। আমারও মনে হয় সময় ফুরাচ্ছে।

তিন বস্তা মালামাল আর একটি কাপড়ের ব্যাগ ট্রলিতে এনেছেন গাফ্্ফার মিয়া। স্টেশনের ৪নং প্ল্যাটফর্ম থেকে অটোরিকশা স্ট্যান্ডে আসার পর তাকে দেওয়া হয়েছে ২০ টাকা। এটা নিয়েই বাকবিতন্ডা। সবশেষ ৫০ টাকায় দফারফা। জানান, সবকিছুর দাম বাড়ে। শুধু আমাদের দিকে কেউ তাকায় না। পরিশ্রম করে টাকা নিই। তাও মানুষ দিতে চায় না। আমরা এখন যাব কোথায়? বাপ-দাদা এ কাজ করত, তাই আমিও কিছু না বুইজা শুরু করি।

সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় জানিয়ে বলেন, আমরা না হয় পথেঘাটে রাত কাটাতে পারি। আমাগোর পোলা-মাইয়ারে তো আর এ কাজ করাতে পারি না। ওদের পড়াশোনা আছে। বাড়তি খরচ আছে। আর পেরে উঠছি না। এবার হয়তো এ লাল পোশাক ছাড়তে হবে। বলে চুপ হয়ে যান তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কুলি জানান, কুলির সরদার স্টেশনে আহে না। হের আইয়া কাম কি… নিজের তো ৬ ছয়তলা বাড়ি আছে। ভালা খায়, ভালা জায়গায় থাইকা ঘুমায়।

কমলাপুর রেলস্টেশনের বেশকিছু জায়গা ঘুরে কথা হয় অনেক কুলির সঙ্গে। খোদ স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ারের সঙ্গেও কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তবে পুরো জায়গা দুই দিন খুঁজেও কুলি সরদার নুরু মিয়াকে পাওয়া যায়নি। তবে কেউ কেউ বলেন, আসেন মাঝেমধ্যে।

কমলাপুর রেলস্টেশনের মাস্টার আফসার উদ্দিন জানান, কর্তৃপক্ষ সরদার নিয়োগ দেয়। আর বাকিদের একটা নম্বর দিয়ে নিয়োগসহ সব কাজ সরদারই করে থাকে। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো টাকার লেনদেন হয় না। তবে নিয়োগের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি নেওয়া হয়।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here